
গুলশান ১ নম্বরে অবস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার মার্কেটে জোসনা আরা বেগমের তিন ছেলের তিনটি দোকান ছিল। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে ছেলেদের দোকানে আগুন লাগার খবর পেয়ে কুমিল্লা থেকে ছুটে আসেন সত্তরোর্ধ্ব জোসনা বেগম। চোখের সামনে ছেলেদের উপার্জনের একমাত্র সম্বলকে ধ্বংস হতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
জোসনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে জায়গা-জমি বেইচ্যা পোলাগো দিছিলাম। এহন তো আমি শেষ হইয়্যা গেলাম। গেরামেও কিছু থাকল না। এইহানেও কিছু রইল না। ছিলাম কোটিপতি এখন পথের ফকির।’
জোসনা বেগমের বড় ছেলে মোখলেছুর রহমানের ছিল ক্রোকারিজের দোকান। মার্কেটের নিচতলায় অবস্থিত দোকানটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। মোকলেছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত আড়াইটার দিকে আগুনের খবর পাই। আইস্যা দেখি ভেতরে ঢোকা যায় না। সব চোখের সামনে পুইড়া গেল।’
মোখলেছুর রহমানের চার মেয়ে ও এক ছেলে। একজন কলেজে ও তিনজন স্কুলে পড়ছে। পরিবার নিয়ে বাড্ডা এলাকায় থাকেন তিনি। পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল এই দোকান। দোকান পুড়ে যাওয়ায় দিশেহারা পুরো পরিবার। মোখলেছুর বলেন, ‘গোডাউন-দোকান মিলায়া ৫০ লাখ টাকার মতো মাল ছিল। কী কইর্যা চলুম বুঝতেছি না। ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার কী হইব, তা-ও জানি না।’
মোখলেছুরের ছোট দুই ভাই জসিমুদ্দীনের মুদিদোকান আর হেলালউদ্দিনের ক্রোকারিজের দোকান ছিল। তাঁদের দোকান দুটিও ধসে পড়েছে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলে, নাতিদের জড়িয়ে ধরে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন জোসনা বেগম।
হঠাৎ লাগা আগুনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন গুলশান ১ নম্বর ডিএনসিসি কাঁচাবাজার মার্কেটের চার শতাধিক দোকানদার। গভীর রাতে লাগা আগুনে চারতলা মার্কেট ভবনের পুরোটাই ধসে পড়ায় মালামাল বের করতে পারেননি দোকানদারেরা। চোখের সামনে দোকান পুড়তে দেখে অনেক দোকানমালিক কান্নায় ভেঙে পড়েন। একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকেন।
২০ বছর ধরে গুলশান কাঁচাবাজার মার্কেটে নিজের দোকান চালান মো. জামাল হোসেন। এই দোকানের আয় দিয়েই তাঁর পরিবার ও চার কর্মচারীর পরিবার চলে। গত সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে আগুন লাগার খবর পেয়ে মার্কেটে ছুটে আসেন জামাল হোসেন ও তাঁর কর্মচারীরা। দোকান থেকে কোনো কিছুই তাঁরা বের করতে পারেননি। এমনকি দোকানে থাকা টাকাও না।
এই দোকানমালিক বলেন, তাঁর এক ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, আরেক ছেলের বয়স ১৮ মাস। মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ নামে তাঁর দোকানে মূলত টকদই, মালাই, মোরব্বা, মাওয়া বিক্রি হয়। বড় বড় অনুষ্ঠানে এখান থেকে ফরমাশ অনুযায়ী এসব খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হয়। খুচরাও বিক্রি হয়।
গত মাসেই দোকানের মালপত্র কেনার জন্য একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন উল্লেখ করে জামাল হোসেন বলেন, ৩০ হাজার ৫০০ টাকা করে ২৪ মাসের মাসিক কিস্তিতে এই টাকা ঋণ নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঋণের মাত্র এক কিস্তি দিছি। স্টাফ ও নিজের বাড়িভাড়ার ২৭ হাজার টাকা এখনো দিতে পারি নাই।’
ব্যবসায়িক ক্ষতির হিসাব কষে মুষড়ে পড়েছেন জামাল হোসেন। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার সময় বারবার ভিজে উঠছিল তাঁর চোখ। তিনি বলেন, ‘ক্যাশে নগদ ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। আড়াইটায় আগুনের খবর পেয়ে চাবি নিয়ে দৌড়ে এসেছি। ভাবলাম, ক্যাশ থেকে টাকাটা নিয়ে আসতে পারলেও সেভ হয়, কিন্তু কিছুই বের করতে পারি নাই।’