উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ।

জুলাই-জাগরণ প্রদর্শনী

অশ্রু, উদ্দীপনায় অভ্যুত্থানের দিনগুলো

দেয়ালে শাফিক উদ্দিন আহনাফের ছবির পাশে আটকে রাখা তার গিটার। সেখানে দাঁড়িয়ে ছোট ভাই ইফতেখার আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘এই গিটার বাজিয়ে কত সুন্দর গান গাইত ভাইয়া।’ আহনাফ বিএএফ শাহীন কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ত। এবার এইচএসসি দেওয়ার কথা ছিল। গত ৪ আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে সে।

আহনাফের ভাই ইফতেখারকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও শারমীন এস মুরশিদ। এ সময় মর্মস্পর্শী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম আলো আয়োজিত ‘জুলাই-জাগরণ’ প্রদর্শনীর উদ্বোধনী আয়োজনে।

জুলাই অভ্যুত্থানের রক্ত আর অশ্রুমাখা দিনগুলো যেন ফিরে এল দৃষ্টির সামনে আবার এ বিশেষ প্রদর্শনীতে। শোক, দুঃখের সঙ্গে প্রত্যয়ের সাহসও জোগাল এ আয়োজন। আজ শুক্রবার ছুটির বিকেলে যৌথভাবে এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান; সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ ও ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার সারাহ কুক। অনুষ্ঠানে বিপুল মানুষের সমাগম হয়েছিল।

জুলাই অভ্যুত্থান ইতিমধ্যে দেশের ইতিহাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে স্বীকৃত। এ ঘটনার এক বিশাল আয়োজন তুলে ধরা হয়েছে দর্শকদের সামনে। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল। প্রদর্শনী চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত, প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা এবং শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ছাত্ররা যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল তাতে যোগ দিয়েছিল ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিনির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ। এই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজ গড়ার সংকল্প ও আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে স্বৈরাচারী সরকার নানা বয়ান তৈরি করছিল। সেই অবস্থায় সত্য তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছে প্রথম আলো। এই প্রদর্শনীতে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রদর্শনীতে ছবিগুলো দেখছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘ইতিহাস সময়-সময় বিকৃত করা হয়। জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট যেন কেউ বিকৃত করতে না পারে, তার একটি বড় সূত্র হিসেবে প্রথম আলোর এ প্রদর্শনী কাজ করবে। স্বৈরাচারের পতন যে লজ্জাজনক হয়, এ প্রদর্শনী তা প্রমাণ করবে। একই সঙ্গে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, আহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতিও আমাদের গভীর বেদনা ও সহানুভূতি জাগাবে। যাঁরা আত্মদান করেছেন, তাঁদের পরিবার ও যাঁরা আহত হয়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’

শারমীন এস মুরশিদ বলেন, ‘২০২৪–এর জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের অন্তরে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। আমরা ১৯৭১–এর যুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪–এর যুদ্ধের মিল খুঁজে পাই। একাত্তরে যেমন তরুণেরা বাড়িতে চিরকুট লিখে রেখে শত্রুর মোকাবিলা করতে যুদ্ধে গিয়েছিল, চব্বিশেও তেমনি কিশোর–তরুণেরা বাবা-মার কাছে চিরকুট লিখে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছে। আত্মদান করেছে, আহত হয়েছে।’

শারমীন মুরশিদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে অর্ধশত বছরেও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। মিথ্যা দিয়ে ইতিহাস লেখা হয়েছে, মিথ্যার ওপর থেকে গায়ের জোরে দেশ শাসন করা হয়েছে; কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানে প্রমাণ হয়েছে, এই জাতি মৃত্যুকে ভয় পায় না। বইয়ে, শিল্পসৃষ্টিতে এ ধরনের প্রদর্শনীর মাধ্যমে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে স্থায়ী রূপ দিতে হবে। যেন আর কোনো স্বৈরাচার ফিরে আসতে না পারে। এ আয়োজনের জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ।

প্রদর্শনীর শুরুতেই চোখে পড়বে লাল-সবুজে ঢাকা প্রতিবাদী এক মুখের ছবি।

সারাহ কুক বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের ছবিগুলো খুবই আবেগময়। তরুণেরা বৈষম্যের অবসান ও গণতন্ত্রের জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিলেন। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে আহত হয়েছেন। যুক্তরাজ্য তাঁদের এ আন্দোলনে প্রথম থেকেই দৃষ্টি রেখেছিল। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য তাদের সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ একটি চিকিৎসক দল জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্রে উত্তরণের যে কাজ করছে, তাতে যুক্তরাজ্য ভূমিকা রাখবে।

প্রদর্শনীতে যা আছে

প্রদর্শনী চলছে জাতীয় চিত্রশালার দোতলায়, ১ নম্বর গ্যালারিতে। গ্যালারির সামনের পশ্চিম ও দক্ষিণ পাশের ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত দুই দেয়াল ঢেকে আছে গত বছরের জুলাই-আগস্টের প্রথম আলোর বিভিন্ন পাতার কোলাজের বিশালাকার ডিজিটাল প্রিন্টে। বড় একটি মনিটরে প্রদর্শিত হচ্ছে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে প্রথম আলোর প্রামাণ্যচিত্র। দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই চোখের সামনে মাথায় লাল-সবুজ পতাকা বাঁধা স্লোগানে দীপ্ত তরুণীর মুখ। এমন অসংখ্য দৃঢ়সংকল্প মুখের স্লোগানে স্লোগানে সে সময় মুখর হয়েছিল সারা দেশ। সামনে এগিয়ে গেলে দেয়ালে দেয়ালে বিরাট আকারের আলোকচিত্র। কোনো কোনো ছবি এত বড় যে একটি ছবিই আছে দেয়ালজুড়ে। যেমন ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশের জনসমুদ্র। গ্যালারির দক্ষিণ প্রান্তে একটি কর্নারের দেয়ালজুড়ে আছে এই ছবি। আরেকটি বিশাল ছবি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদের সামনে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠা জনতার ঢল। এসব ছবির সামনে দাঁড়ালে একটা অন্য রকম অনুভূতি জাগে মনে।

অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী দেখছেন অতিথিরা।

আরও আছে রাজপথে পড়ে থাকা মৃতদেহ, মিছিলে নামা ছাত্রীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের ট্রলিতে পড়ে থাকা ছররা গুলিতে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। রাজপথে মিছিল, পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধস্তাধস্তি, গ্রেপ্তার, দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো বীর আবু সাঈদের প্রতিরোধসহ অনেক দৃশ্য রয়েছে। এগুলো ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন প্রথম আলোর আলোকচিত্র সাংবাদিকেরা।

এ ছাড়া ‘সত্যে তথ্যে জুলাই’ নামে রয়েছে বিভিন্ন দিনের প্রথম আলো পত্রিকার বড় আকারের ডিজিটাল প্রিন্ট। প্রথম পাতার সংবাদ। অভ্যুত্থানের পক্ষে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা যে প্রবন্ধ–নিবন্ধ লিখেছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেগুলোও আছে। অভ্যুত্থান নিয়ে তরুণ কবিদের কবিতার পাতা করেছিল প্রথম আলো, সেটিও আছে। প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির মূল ভাবনা ছিল ‘জেগেছে বাংলাদেশ’। জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে এ মূল ভাবনা অবলম্বনে চারটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোও আছে। অনলাইনে যেসব সংবাদ ও ভিডিও সম্প্রচারিত হয়েছে, দুটি কক্ষে সেগুলো বড় পর্দায় দেখানো হচ্ছে।

শহীদ আবু সাঈদকে নিয়ে শিল্পী শহীদ কবির যে শিল্পকর্ম করেছেন, সেই শিল্পকর্মসহ তার একটি ভিডিও রয়েছে একটি কক্ষে। আরেক পাশে আছে আন্দোলন দমাতে বিভিন্ন বাহিনীর ব্যবহৃত প্রাণঘাতী গুলির খোসা, গ্রেনেডের পিন, ছররা গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল প্রভৃতি।

অভ্যুত্থানে ব্যবহৃত গুলির খোসা, টিয়ার শেলের খোসা স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে

তবে প্রদর্শনীর সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অংশটি পশ্চিম পাশে। এ অংশের নাম ‘শহীদ স্মরণ’। আবু সাঈদ, মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, মাহমুদুর রহমান সৈকত, শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ, নাঈমা সুলতানা ও শিশু জাবির ইব্রাহীমের প্রতিকৃতির সঙ্গে জন্ম–মৃত্যুর তারিখসহ সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। আর ফ্রেমে ফ্রেমে পরিবারের সঙ্গে তাদের জীবনের মধুর মুহূর্তের ছবি। মেঝেতে কাচে ঢাকা টেবিলে সাজানো তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, তাতে আছে তাদের স্পর্শের স্মৃতি। এসব ছবি আর সামগ্রীর সামনে দাঁড়ালে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখ ভিজে আসে। সব মিলিয়ে জুলাই অভ্যুত্থান ছবিতে, শব্দে, লেখনীতে যেন ফিরে এসেছে আবার জাতীয় চিত্রশালায়। প্রদর্শনী আয়োজনে সহযোগিতা করেছে প্রাইম ব্যাংক, সৌজন্যে শিল্পকলা একাডেমি।

প্রদর্শনী ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা

অনুষ্ঠানমালা

প্রদর্শনী উপলক্ষে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। এসব অনুষ্ঠান শুরু হবে বিকেল চারটায়। ২৬ জানুয়ারি থাকবে গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে বইয়ের প্রকাশনা ও আলোচনা। অতিথি থাকবেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে ২৭ জানুয়ারি।

গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত বিশেষ ভিডিও উদ্বোধন ২৯ জানুয়ারি। অতিথি থাকবেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস। সমাপনী আয়োজন ৩১ জানুয়ারি, থাকবে আহমেদ হাসান সানি ও কাকতালের গান।