সাদেক হোসেন খোকা মাঠের এ জায়গা জেলা প্রশাসনের নথি অনুযায়ী একসময় পুকুর ছিল। প্রায় ৬৬ শতক আয়তনের এ জায়গায় এখন খেলার মাঠ ও দর্শকদের বসার গ্যালারি রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায়
সাদেক হোসেন খোকা মাঠের এ জায়গা জেলা প্রশাসনের নথি অনুযায়ী একসময় পুকুর ছিল। প্রায় ৬৬ শতক আয়তনের এ জায়গায় এখন খেলার মাঠ ও দর্শকদের বসার গ্যালারি রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায়

‘পুকুরচুরি’র শিকার ঢাকার ৩১ পুকুর

  • ৫৮টি পুকুরের মধ্যে ৩১টি ভরাট হয়ে গেছে।

  • ২০টি পুকুরের জমির পুরো ও আংশিক অবৈধ দখলদার বিভিন্ন ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

  • তিনটি পুকুরের জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।

  • সরকারিভাবে তিনটি পুকুরের জায়গা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে।

  • পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে দুটি পুকুর।

  • জেলা প্রশাসন রাজউককে চিঠি দিয়েছে ২০২৩ সালে। উদ্দেশ্য সংস্কার, পুনঃখনন, পাড় বাঁধাই ও হাঁটার রাস্তা নির্মাণ।

  • রাজউক এখনো কিছু করেনি।

সরকারি নথিতে রাজধানীর বাউনিয়ায় বড়সড় একটি পুকুর আছে। জমির দাগ নম্বর ধরে খুঁজতে গেলাম পুকুরটিকে। গিয়ে দেখা গেল, সেখানে গড়ে উঠেছে কয়েকটি টিনের ছাউনির ঘর ও একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এমনকি সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ও করা হয়েছে সরকারি পুকুরের জমিতে।

যেখানে পুকুর ছিল, তার কাছেই একটি বাড়িতে থাকেন এক প্রবীণ ব্যক্তি। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, তিনি ওই এলাকায় বাস করেন চার দশকের বেশি সময় ধরে। পুকুরটি তিনি দেখেছেন। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা গোসল করতেন। মাছ ধরতেন। বছর ১০-১২ আগে পুকুরটি ভরাট করা শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যে পুরো ভরাট করে স্থাপনা গড়ে উঠেছে।

বাউনিয়ার পুকুরটি নিয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুকুরের জমির অবৈধ দখলদারের সংখ্যা ১৯।

ঢাকা জেলা প্রশাসন ২০২৩ সালের নভেম্বরে ঢাকার পুকুরগুলো নিয়ে সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে পাঠায়। এতে রাজধানীতে থাকা খাস ও ভিপি (অর্পিত সম্পত্তি) জমিতে ৫৮টি পুকুরের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়।

জেলা প্রশাসন রাজউককে চিঠিটি দিয়েছিল পুকুরগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার, পুনঃখনন, পাড় বাঁধাই ও হাঁটার রাস্তা নির্মাণ করার জন্য, যাতে তা দখলমুক্ত থাকে এবং অগ্নিদুর্ঘটনার সময় পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

এই প্রতিবেদক গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দাগ নম্বর ধরে রাজধানীর পুকুরগুলোর খোঁজ করেছেন। জানুয়ারি মাসে বাউনিয়ায় গিয়ে খোঁজ করা হয় সেখানে থাকা পুকুরটির। দেখা যায়, ৭৭ শতক আয়তনের পুকুরটির কোনো অস্তিত্ব নেই।

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন, রাজউকের জরিপ ও প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধান অনুযায়ী, ৫৮টির মধ্যে ৩১টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এ যেন পুকুরচুরি! পুকুরচুরি বাগ্‌ধারাটির অর্থ বড় ধরনের চুরি। ঢাকার সেই পুরোনো পুকুরগুলো বড় ধরনের চুরিরই শিকার হয়েছে।

৩১টির মধ্যে ২০টি পুকুরের জমির পুরো ও আংশিক অবৈধ দখলদার বিভিন্ন ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দুটি পুকুরের আংশিক জায়গায় গড়ে উঠেছে ধর্মীয় স্থাপনা। তিনটি পুকুরের জায়গায় বানানো হয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। খেলার মাঠ ও উদ্যান হয়ে গেছে দুটি পুকুরের জায়গা। পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে দুটি পুকুর। সরকারিভাবে তিনটি পুকুরের জায়গা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা অধিগ্রহণ করেছে।

বাকি ২৭টি পুকুরের মধ্যে ৯টি কোনোমতে টিকে আছে। আশপাশের জলাশয়ের সঙ্গে ডুবে আছে ১৪টি। সেগুলোকে আলাদা করা কঠিন। চারটি পুকুরের সর্বশেষ অবস্থা জানা যায়নি। এসব পুকুরের অবস্থান সম্পর্কে প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।

এই প্রতিবেদক গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় দাগ নম্বর ধরে রাজধানীর পুকুরগুলোর খোঁজ করেছেন। জানুয়ারি মাসে বাউনিয়ায় গিয়ে খোঁজ করা হয় সেখানে থাকা পুকুরটির। দেখা যায়, ৭৭ শতক আয়তনের পুকুরটির কোনো অস্তিত্ব নেই। জমির এক পাশে বাউনিয়া ভূমি অফিসের (মিরপুর রাজস্ব সার্কেল) একতলা ভবন। কার্যালয়টির সামনে কিছু জমি খালি। সেখানে যে সাম্প্রতিককালে বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে, তা বোঝা যায়। কারণ, কোনো ঘাস এখনো জন্মায়নি। পুকুরটির বাকি জমিতে ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা।

ভূমি অফিসে গিয়ে পাওয়া গেল ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তা হামিদুর রহমানকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কার্যালয় নির্মাণের আগেই পুকুর ভরাট হয়ে গিয়েছিল। অবৈধ দখলদার ছিল। পরে জায়গা উদ্ধার করে ২০২১ সালে ভূমি অফিস নির্মাণ করা হয়।

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন, রাজউকের জরিপ ও প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধান অনুযায়ী, ৫৮টির মধ্যে ৩১টি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। এ যেন পুকুরচুরি! পুকুরচুরি বাগ্‌ধারাটির অর্থ বড় ধরনের চুরি। ঢাকার সেই পুরোনো পুকুরগুলো বড় ধরনের চুরিরই শিকার হয়েছে।

পুকুরের খোঁজে

ঢাকা জেলা প্রশাসনের নথি বলছে, রাজারবাগ মৌজার ৭৩৪০ নম্বর দাগের প্রায় পৌনে ১১ শতক আয়তনের একটি পুকুর রয়েছে। পূর্ব রাজারবাগে গিয়ে পুকুর খোঁজ পেতে বেগ পেতে হয়। পরে রাজউকের প্রতিবেদনে দেওয়া জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) লোকেশন মুঠোফোনে দেখে পুকুরের জায়গাটি চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। মিলিয়ে দেখা যায়, রাজউক পুকুরের জায়গায় যে স্থাপনার কথা বলেছে এবং ছবি দিয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে।

পুকুরটির জায়গার কিছু অংশে স্থানীয় লোকজন বেশ কয়েকটি ২-৩ তলা বাড়ি করেছেন। কিছু অংশে টিনের ছাউনির কিছু ঘর আছে। মাঝখানে কিছুটা খালি জায়গা। সেটি মূলত আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। পুরোটা ময়লা-আবর্জনায় ভরা।

পুকুরের জায়গায় তোলা ঘরে বসবাসকারী কয়েকজনের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা পুকুর থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন। পাশাপাশি জায়গাটি দেখে ফেরার পথে স্থানীয় এক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে থামিয়ে সেখানে যাওয়া এবং ছবি তোলার কারণ জানতে চান। ওই ব্যক্তির দাবি, জায়গাটি তাঁরা কিনেছেন, সেখানে কখনো কোনো পুকুর ছিল না।

পুকুরটির জায়গার কিছু অংশে স্থানীয় লোকজন বেশ কয়েকটি ২-৩ তলা বাড়ি করেছেন। কিছু অংশে টিনের ছাউনির কিছু ঘর আছে। মাঝখানে কিছুটা খালি জায়গা। সেটি মূলত আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। পুরোটা ময়লা-আবর্জনায় ভরা।

অবশ্য স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ওই ব্যক্তি পুকুরের জায়গার অবৈধভাবে দখলদারের একজন। তাঁর নাম রুবেল।

এটি একসময় পুকুর ছিল। বর্তমানে ভূমি কার্যালয়ের রাজস্ব সার্কেলের একটি ভবন হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর খিলক্ষেতের বটতলা এলাকায়

ঢাকা জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে হাজারীবাগের কাছে কালুনগর মৌজার ৪১২ নম্বর দাগে প্রায় ৬২ শতক আয়তনের একটি পুকুর রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে রাজউকের প্রতিবেদন বলছে, পুকুরটি অবৈধভাবে ভরাট করা হয়েছে। এর একটি অংশে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকিটা খালি পড়ে আছে। কামরাঙ্গীরচরের মাহাদীনগর আবাসিক এলাকায় এর অবস্থান। সরেজমিনে দেখা যায়, বালু ফেলে পুকুরটি ভরাট করা হয়েছে। এক পাশে ১৩ তলা একটি ভবন নির্মাণাধীন।বছর পাঁচেক আগেও পুকুরটি পরিত্যক্ত ডোবার মতো ছিল বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা লোকমান আলী। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে পুরো পুকুরটিই ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

রাজউকের প্রতিবেদন বলছে, কোতোয়ালি সার্কেলের ওয়ারী মৌজায় পাশাপাশি থাকা ৪১৬৩ ও ৪২৪৭ দাগের দুটি পুকুরই ভরাট করে দখল করা হয়েছে। প্রথম পুকুরের আকার ছিল প্রায় ৫১ শতক। জায়গাটি মুন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ভরাট করেছে। তবে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তমা গ্যাস কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। তবে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে থাকা কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

দ্বিতীয় পুকুর হয়ে গেছে কামরুন্নেছা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ। প্রায় দুই দশক আগে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুকুরটি ভরাট করে মাঠ বানিয়েছে বলে জানালেন ওই বিদ্যালয়ের একজন নিরাপত্তাকর্মী।

এ ছাড়া যাত্রাবাড়ীর দনিয়া মৌজায় পুকুরের জায়গায় রিকশার গ্যারেজ ও অস্থায়ী টিনের ছাউনির ঘর, ভূমি অফিসের মতিঝিল সার্কেলের আওতাধীন মান্ডা এলাকায় একটি পুকুরের জায়গায় বেসরকারি বিদ্যালয়ের মাঠ, কদমতলী মৌজায় একটি পুকুরের জায়গায় ফিলিং স্টেশন ও কারখানা, যাত্রাবাড়ী মৌজায় একটি পুকুরের জায়গায় বিপণিবিতান, বাহ্মণচিরন মৌজায় একটি পুকুরের জায়গায় অটোরিকশা ও রিকশার গ্যারেজ, বসুপাড়া মৌজায় একটি পুকুরের জায়গা স্থানীয়দের দখল এবং ওয়ারী মৌজার একটি পুকুরের জায়গায় ১৬ তলা ভবন গড়ে তোলা হয়েছে।

কামরাঙ্গীরচরের মাহাদীনগর আবাসিক এলাকায় এর অবস্থান। সরেজমিনে দেখা যায়, বালু ফেলে পুকুরটি ভরাট করা হয়েছে। এক পাশে ১৩ তলা একটি ভবন নির্মাণাধীন।বছর পাঁচেক আগেও পুকুরটি পরিত্যক্ত ডোবার মতো ছিল বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা লোকমান আলী। তিনি বলেন, ধীরে ধীরে পুরো পুকুরটিই ভরাট করে ফেলা হয়েছে।

পুকুরের জায়গায় সরকারি প্রতিষ্ঠান

মিরপুর সার্কেলের বাউনিয়া মৌজার আরও দুটি পুকুর ভরাট করে সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট সার্কেলের জোয়ারসাহারা মৌজার ৭৮৭৩ নম্বর দাগের প্রায় ৪২ শতক জায়গায় ভূমি কার্যালয় করা হয়েছে। আর দক্ষিণখান মৌজার ২৫৮২, ২৫৮৩ ও ২৫৮৪ দাগের ৫০ শতক জমিতে করা হয়েছে দক্ষিণখান ভূমি অফিসের কার্যালয়। জেলা প্রশাসন ও রাজউকের প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, খিলক্ষেতের বটতলা এলাকায় পুকুরের জায়গায় ভূমি কার্যালয়ের তিনতলা ভবন। ২০২১ সালে ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ভবনের সামনে কিছু ফাঁকা জায়গায় ফুল ও সবজির বাগান।

বটতলার বাসিন্দা সোলায়মান হোসেন বলেন, ভবন নির্মাণের আগে ওই জায়গা নিচু ছিল। তখন সেখানে রিকশার গ্যারেজ ও কিছু বস্তিঘর ছিল।

তবে সেখানে পুকুর ছিল, এমন তথ্য জানা নেই বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ওই রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শোয়েব শাত-ঈল ইভান।

দ্বিতীয় পুকুর হয়ে গেছে কামরুন্নেছা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ। প্রায় দুই দশক আগে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুকুরটি ভরাট করে মাঠ বানিয়েছে বলে জানালেন ওই বিদ্যালয়ের একজন নিরাপত্তাকর্মী।
বাউনিয়া মৌজার প্রায় ৭৭ শতকের এ জায়গাটি একসময় পুকুর ছিল। পুরো জায়গা ভরাট করে গড়ে উঠেছে ভূমি কার্যালয়। সম্প্রতি রাজধানীর তুরাগের বাউনিয়া এলাকায়

ভরাট করে সরকারি কার্যালয় গড়ে তোলার পাশাপাশি বরাদ্দ কিংবা স্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়েও পুকুর ধ্বংস করা হচ্ছে। মিরপুরের চণ্ডালভোগ মৌজার ৬২ দশমিক ৮৮ শতক পুকুরের জায়গা থেকে ৩৫ শতক রাজউক অধিগ্রহণ করেছে। সাড়ে ৯ শতক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে একটি সরকারি সংস্থাকে। পাঁচ শতক এক ব্যক্তিকে বন্দোবস্ত দিয়েছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন ও রাজউকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেজগাঁও সার্কেলের বিভিন্ন মৌজায় পাঁচটি পুকুরের জায়গা ভরাট করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি পুকুর ভরাট করে আবাসনপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক প্লট করেছে। একটি পুকুর পাশের জায়গার মালিকেরা বালু ফেলে ভরাট করে রেখেছেন।

জেলা প্রশাসন ও রাজউকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাড্ডার সাতারকুল মৌজার ৮৬৪৯ নম্বর দাগের ৯ দশমিক ৩৪ শতক জায়গা স্বদেশ প্রপার্টিজ এবং ৪৯৪৪ নম্বর দাগের ৪ শতক জায়গা নেপচুন হাউজিংয়ের দখলে রয়েছে। গজারিয়া মৌজার ১০৩৫০ নম্বর দাগের প্রায় ৪ শতক জায়গা পাশের জায়গার মালিকেরা দখলে নিয়েছেন।

জেলা প্রশাসন ও রাজউকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেজগাঁও সার্কেলের বিভিন্ন মৌজায় পাঁচটি পুকুরের জায়গা ভরাট করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি পুকুর ভরাট করে আবাসনপ্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক প্লট করেছে। একটি পুকুর পাশের জায়গার মালিকেরা বালু ফেলে ভরাট করে রেখেছেন।

পুকুরে ময়লা-আবর্জনা

যে ১৪টি পুকুর নির্দিষ্ট করা যায়নি, সেগুলো পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। অবশ্য এগুলো এখনো বেহাত হয়নি। যে ৯টি পুকুর দৃশ্যমান, সেগুলোর বেশির ভাগের পানি নোংরা। কয়েকটিতে আশপাশের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়।

সরেজমিনে লালমাটিয়ার শাহি মসজিদ কমপ্লেক্স-সংলগ্ন (বিবির মসজিদ নামেও পরিচিত) পুকুরের পানি নোংরা পাওয়া গেছে। ২ দশমিক ১১৪০ একর আয়তনের বিশাল পুকুরটিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে দেখা গেছে।

মতিঝিল মৌজায় গুলিস্তান শহীদ মতিউর রহমান শিশুপার্কের ভেতরের পুকুরের পানিও নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত। রমনা মৌজার শ্রীশ্রী রমনা কালী মন্দিরসংলগ্ন পুকুরে পলিথিনসহ ময়লা-আবর্জনা দেখা যায়।

পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা দুটি পুকুরও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মিরপুর সার্কেলের দিয়াবাড়ি মৌজার উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশনসংলগ্ন পুকুরটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ৪৫ দশমিক ৪৮ শতক আয়তনের এই পুকুরের তিন দিকে আধপাকা বাড়ি ও টংদোকান রয়েছে। পুকুরের জায়গায় এলাকাবাসী ময়লা-আবর্জনাও ফেলেন।

ঢাকায় পুকুর মাত্র ২৪১টি

২০২৩ সালের জুনে ঢাকার পুকুর ও জলাশয় নিয়ে প্রকাশিত রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় এখন ২৪১টি পুকুর কোনোমতে টিকে আছে। যেখানে মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দুই হাজারের মতো পুকুর ছিল।

আরডিআরসির প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শহরে ১৫ শতাংশ এলাকায় জলাশয় প্রয়োজন হলেও ঢাকায় আছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশ। জলাশয় না থাকায় বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা হচ্ছে, দ্রুত নিচে নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এতে শহরে মিঠাপানির সংকট তীব্র হবে। রাজধানীতে উন্নয়নের নামে এবং সরকারি সংস্থাগুলোর জলাশয় সংরক্ষণ আইন সম্পর্কে অবহেলা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের কারণে ঢাকায় জলাভূমি ভরাট হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আরডিআরসির চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। প্রশাসক হওয়ার আগে গত জানুয়ারিতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে দখলের বাণিজ্য হয়েছে। পুকুর রক্ষার বিষয়টিও সরকারের প্রায়োরিটি এজেন্ডায় (অগ্রাধিকারে) ছিল না। এমনকি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও পুকুর ভরাট করে ভবন বানিয়েছে। পুকুরের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা দুটি পুকুরও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। মিরপুর সার্কেলের দিয়াবাড়ি মৌজার উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশনসংলগ্ন পুকুরটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ৪৫ দশমিক ৪৮ শতক আয়তনের এই পুকুরের তিন দিকে আধপাকা বাড়ি ও টংদোকান রয়েছে। পুকুরের জায়গায় এলাকাবাসী ময়লা-আবর্জনাও ফেলেন।
রাজারবাগ মৌজার ৭৩৪০ নম্বর দাগের প্রায় পৌনে ১১ শতক আয়তনের একটি পুকুর রয়েছে। স্থানীয় লোকজন বেশ কয়েকটি ঘর করেছেন সেখানে। মাঝের খালি জায়গাটুকু আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে

রাজউক কী করবে

ঢাকা জেলা প্রশাসন যে ৫৮টি পুকুর রাজউকের দায়িত্বে দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৫১টি খাসজমিতে। বাকি সাতটি অর্পিত সম্পত্তি। জেলা প্রশাসন চিঠি দেওয়ার পর রাজউক পুকুরগুলোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অবশ্য পুকুরগুলো রক্ষা ও উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন রাজউকের প্রধান নগর–পরিকল্পনাবিদ (চলতি দায়িত্ব) আশরাফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে পুকুর রয়েছে, সেগুলো পুকুর হিসেবেই সংরক্ষণ করা হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য পুকুর খননসহ পাড়ে হাঁটার রাস্তা, বসার ব্যবস্থা করা হবে।

অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে জানিয়ে রাজউকের এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, প্রথম পর্যায়ে ৩৫টি পুকুর বেছে নেওয়া হয়েছে। জনগণকে উৎসাহিত করতে প্রথমে এসব পুকুর সংস্কার করে জনপরিসর বানানো হবে। আগামী জুলাই মাস নাগাদ পুকুর উন্নয়নের কাজ শুরু হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বেদখল হওয়া পুকুর পুনরুদ্ধারের কাজ করা হবে।

যেসব পুকুরের জায়গায় সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান আশরাফুল ইসলাম।

সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে যারাই পুকুর ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানার এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ পুকুর ভরাট কিংবা দখলের সাহস না পায়। পাশাপাশি জরিমানার অর্থ দিয়ে যাতে পুকুর উদ্ধারের কাজও করা যায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান

পুকুর কেন দরকার

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ।

পুকুর স্থানীয় পর্যায়ে পানি সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ জলাধার। এর প্রতিবেশগত গুরুত্ব অনেক। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নগরে পুকুর থাকার পরিবেশগত ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পুকুর বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা কমাতে সহায়ক। পুকুরের পানি ধীরে ধীরে ভূগর্ভে প্রবেশ করে, যা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে উন্নত করতে সাহায্য করে। পুকুরের জলীয় বাষ্প আশপাশের পরিবেশকে শীতল রাখে। পুকুর বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল, যা শহরের জীববৈচিত্র্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। পুকুর শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায় এবং মানুষের মনে শান্তি এনে দেয়।

জরুরি প্রয়োজনে পুকুরের পানি ব্যবহার করা যায়। যেমন ২০২৩ সালে ঢাকা নিউমার্কেট লাগোয়া নিউমার্কেটের ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস পানি এনেছিল ঢাকা কলেজের পুকুর থেকে।

জানতে চাইলে নগর-পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি, বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ে যারাই পুকুর ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আইন অনুযায়ী জেল-জরিমানার এমন দৃষ্টান্ত তৈরি করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ পুকুর ভরাট কিংবা দখলের সাহস না পায়। পাশাপাশি জরিমানার অর্থ দিয়ে যাতে পুকুর উদ্ধারের কাজও করা যায়।

পুকুর উদ্ধারের পর সংস্কারকাজে স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, সংস্কারের নামে পুকুরকে যাতে অতিরিক্ত কংক্রিট দিয়ে আচ্ছাদিত করা না হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।