রাশিয়ার টিকা স্পুতনিক-ভি জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। আজ মঙ্গলবার টিকার অনুমোদন নিয়ে সভা ডেকেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেলে রাশিয়ার এই টিকা আমদানি ও ব্যবহারে আইনগত বাধা থাকবে না।
এদিকে রাশিয়া থেকে টিকা আনতে গোপনীয়তার চুক্তির পর প্রক্রিয়া আরেকটু এগিয়েছে। রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট সংস্থা বাংলাদেশকে ১৮ পাতার একটি চুক্তিপত্র পাঠিয়েছে। সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, কিনতে চাইলে রাশিয়া বাংলাদেশকে আগামী মাস অর্থাৎ মে থেকেই টিকা দিতে পারবে।
ঔষধ প্রশাসনের আজকের সভায় স্পুতনিক-ভি টিকার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এলে বাংলাদেশে অনুমোদন পাওয়া টিকার সংখ্যা দাঁড়াবে দুটি। এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত জরুরি জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ওষুধ, পরীক্ষামূলক ওষুধ, টিকা ও মেডিকেল সরঞ্জামবিষয়ক কমিটি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছিল।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কমিটির সদস্যদের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছে, তাতে আজকের সভার আলোচ্য বিষয় মাত্র একটি। তা হলো স্পুতনিক-ভির জরুরি অনুমোদন বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ চিঠিই বলে দিচ্ছে যে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি।’
চুক্তিপত্র পাঠিয়েছে রাশিয়ার আরডিআইএফ। স্পুতনিক-ভি টিকার কার্যকারিতা ৯১%। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন এখনো পায়নি।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় জনস্বাস্থ্যবিদ, টিকা বিশেষজ্ঞ, ওষুধবিজ্ঞানী ও রোগতত্ত্ববিদেরা এই কমিটির সদস্য। কমিটির চারজনের সঙ্গে কথা হলে প্রত্যেকেই রাশিয়ার টিকার অনুমোদনের ব্যাপারে ইতিবাচক মত দেন।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন দিলে এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড—এই সাত দেশে ব্যবহারের অনুমোদন থাকলে সেসব ওষুধ, টিকা বা চিকিৎসাসামগ্রী বাংলাদেশে অনুমোদন দেওয়া হয়। ধরে নেওয়া হয় বৈজ্ঞানিভাবে কার্যকর ও নিরাপদ বলেই এসব ওষুধ ও টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ওই দেশগুলো অনুমোদন দেয়। কিন্তু রাশিয়ার টিকাটি ওই সব দেশ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন এখনো পায়নি। সে কারণে টিকাটির বিশেষ অনুমোদন দরকার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ল্যানসেট–এর গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে, রাশিয়ার টিকার কার্যকারিতা ৯১ শতাংশের কিছু বেশি। মাঠ গবেষণায় দেখা গেছে, কার্যকারিতা ৯৬ শতাংশের বেশি। টিকাটি ৫০টির বেশি দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষ এই টিকা নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য টিকা এখন জরুরি প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের জন্য বসে থাকার সময় নেই। জরুরি অনুমোদনের নজির অন্য অনেক দেশে আছে।
ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল এক্সপার্ট গ্রুপ (এনআইটিইজি) বেশ কয়েকটি টিকার ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল। এর মধ্যে থেকে আপাতত রাশিয়ার টিকা জরুরি অনুমোদন পেতে যাচ্ছে বলে সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এনআইটিইজির সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী আলী কাওসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে, এমন টিকা থেকে আমরা বাছাই করে তালিকা তৈরি করেছি। আমরা টিকাগুলোর কার্যকারিতার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি, দেখতে চেয়েছি এগুলো কতটা নিরাপদ।’ তিনি বলেন, ‘প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ থেকে আমরা তথ্য নিয়েছি এবং তা সরকারকে দিয়েছি। যে টিকাটি তালিকার নিচে আছে, তা–ও ২২টি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।’
ভারত থেকে টিকা আসা অনেকটা অনিশ্চিত হওয়ার পর সরকার ১৯ এপ্রিল আট সদস্যের ‘কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রাপ্তির উৎস ও সংগ্রহসংক্রান্ত কোর কমিটি’ গঠন করে। কোন টিকা ক্রয় করা সরকারে জন্য সমীচীন হবে, সে ব্যাপারে সুপারিশ করা কমিটির একটি কাজ ছিল। ওই কমিটি প্রথম সভা করে ২১ এপ্রিল। ওই সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা স্পুতনিক-ভি বা সিনোফার্মের টিকা আমদানি অনুমোদনের জন্য এনআইটিইজির পরামর্শের প্রয়োজনের কথা বলেন। সূত্র বলছে, এরপর এনআইটিইজির কাছে বিভিন্ন দেশের টিকার ব্যাপারে তথ্য চায় কোর কমিটি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, যেকোনো ওষুধের অনুমোদনের জন্য আমদানিকারককে টিকার অনুমোদন পরিস্থিতি, ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা রিপোর্ট, টিকার মূল্য, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, দ্রততম সময়ে সরবরাহের নিশ্চয়তা, কার্যকারিতা, কতটা নিরাপদ—এসব তথ্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দিতে হয়।
করোনার টিকা নিয়ে গঠিত কোর কমিটি রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্মের টিকা সংগ্রহের জন্য প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করেছে। কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, তারা মোট সাতটি টিকা নিয়ে আলোচনা করে। এর মধ্যে চীনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম, স্পুতনিক-ভি, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা ছিল। কমিটি বলছে, তারা নিরাপত্তা, কার্যকারিতা, সংরক্ষণের সুবিধা, দাম ও টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যবহারের সক্ষমতা বিবেচনায় চীনের সিনোফার্ম ও রাশিয়ার স্পুতনিক-ভি টিকা দুটি সংগ্রহের প্রাথমিক সুপারিশ করে।
কার্যবিবরণীতে আরও বলা হয়, সিনোফার্মের টিকার কার্যকারিতা ৭৯ শতাংশ। এটি চীনের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত এবং বিশ্বের ৩৪টি দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর দাম প্রতি ডোজ প্রায় ১৯ থেকে ৪৪ ডলার। আমদানিকারক হবে সরকার এবং আমদানির পরিমাণ ও সময়কাল চীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ ঠিক করবে।
অন্যদিকে স্পুতনিক-ভি টিকার কার্যকারিতা ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ উল্লেখ করে কার্যবিবরণীতে বলা হয়, এটি রাশিয়ার ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত। বিশ্বের ৬১টি দেশে এ টিকা ব্যবহৃত হচ্ছে। দাম প্রতি ডোজ ১০ থেকে ২০ ডলার। এটিও আমদানি করবে সরকার। সরকারিভাবে কমিটিকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর মে থেকে ডিসেম্বর সময়ে এ টিকার ২ কোটি ৪০ লাখ ডোজ এবং আগামী জানুয়ারি থেকে এপ্রিল সময়ে ৩ কোটি ৬০ লাখ ডোজ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কমিটির সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, সিনোফার্ম ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে ও রাশিয়ার স্পুতনিক-ভির জন্য জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন বা ইমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশন (ইইউএ) দেওয়ার জন্য নীতি পরিবর্তন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত শনিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। ইইউএ প্রদানের জন্য দ্রততম সময়ে তথ্য প্রাপ্তির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমদানিকারক বরাবর আগ্রহপত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট পাঠানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, টিকা সরবরাহের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে রাশিয়ার আরডিআইএফ বাংলাদেশকে ১৮ পাতার একটি চুক্তিপত্র পাঠিয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান গোপনীয়তার চুক্তি সই করেছিল। এই চুক্তিতে রাশিয়ার আরডিআইএফের সই করা অনুলিপি মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের হাতে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে গত রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন একটি চিঠি দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চিঠিতে সচিব জানান, দ্রুততম সময়ের মধ্যে টিকা সংগ্রহের জন্য রাশিয়া বাংলাদেশকে নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অনুরোধ করেছে।
দেশে ভারত থেকে টিকা আসা অনিশ্চয়তায় পড়ায় গণটিকাদান কর্মসূচিতে ছেদ পড়েছে। গতকাল সোমবার থেকে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম ডোজ দেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার জন্য মজুত সরকারের হাতে নেই।