আজিমপুরে অভিযান

এপ্রিল থেকে সস্ত্রীক নিখোঁজ ছিলেন তানভীর

রাজধানীর আজিমপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত ব্যক্তির নাম তানভীর কাদেরী বলে পরিবার নিশ্চিত করেছে। তাঁর বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার পশ্চিম বাটকামারি গ্রামে।
তানভীর কাদেরীর বাবা আবদুল বাতেন কাদেরী গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, চলতি বছরের এপ্রিলের ২৭ থেকে ২৯ তারিখের মধ্যে কোনো এক দিন বাড়িতে ফোন করে তানভীর জানান যে তিনি স্ত্রী, দুই বাচ্চাসহ মালয়েশিয়া যাচ্ছেন। এই বলে মা-বাবার কাছ থেকে বিদায় নেন। তারপর থেকে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিলেন। এরপর গত সোমবার বিকেলে গাইবান্ধা সদর থানায় ডেকে নিয়ে পুলিশ মরদেহের ছবি দেখালে আবদুল বাতেন ছেলেকে শনাক্ত করেন।
আজিমপুরে জঙ্গিদের ভাড়া করা একটি বাসায় গত শনিবার পুলিশের অভিযানের সময় তানভীর নিহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গ সূত্র বলছে, তানভীরের জখমের ধরন দেখে মনে হচ্ছে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ওই বাসা থেকে যে তিনজন নারীকে গ্রেপ্তার ও তিন শিশু-কিশোরকে উদ্ধার করা হয়, তাদের একজন তানভীরের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা (আশা)। শিশুদের মধ্যে একজন তানভীরের ছেলে। তানভীরের আরেক ছেলে অন্য কোথাও রয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ।
আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে তানভীর সর্বশেষ ডাচ্-বাংলা মোবাইল ব্যাংকিং শাখায় কর্মকর্তা ছিলেন। তানভীরের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি প্রকল্পের কর্মকর্তা। দুজনে ২০১৪ সালে হজ করেন। এরপর তাঁদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তানভীরের স্ত্রী হিজাব পরা শুরু করেন। তবে তাঁরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে কিছু জানেন না বলে বাবা দাবি করেন।
ছেলের লাশ নেবেন কি না—জানতে চাইলে আবদুল বাতেন বলেন, ‘আমার পরিবারের কেউ লাশ নিতে রাজি নন। তবে বাবা হিসেবে ছেলের লাশ দাফন করা কর্তব্য। তাই ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী ছেলের লাশ দাফন করতে চাই। কোথায় দাফন করব, সেটা লাশ পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেব।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা বলছেন, নিহত তানভীর, তাঁর স্ত্রীসহ আজিমপুর থেকে আটক অপর নারীরা সবাই নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত। জঙ্গি দলে জড়ানোর পর তানভীর সংগঠনে জামসেদ ও আবদুল করিম নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর সাংগঠনিক নাম হলো খাদিজা। আটকের পর তিনি পুলিশকেও খাদিজা নাম বলেছিলেন।
গ্রেপ্তার তিন নারী পুলিশি পাহারায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তাঁদের মধ্যে তানভীরের স্ত্রী আবেদাতুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। তাঁর মাথার পেছনে ধারালো অস্ত্রের কোপ আছে। পুলিশের ধারণা, অভিযানের পর তানভীর ছুরি দিয়ে নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেন। এর আগে স্ত্রীকেও কুপিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন।

>আজিমপুরে অভিযান
* পুলিশ বলছে, নিহত তানভীর, তাঁর স্ত্রীসহ আজিমপুর থেকে আটক অপর নারীরা নব্য জেএমবির সদস্য
* আটকদের মধ্যে আছেন নব্য জেএমবির নেতা মারজানের স্ত্রীও
* মেজর জাহিদের বড় মেয়েকে পাওয়া গেছে

পুলিশ বলছে, ওই বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ১৪ বছরের কিশোর ছেলেটি তানভীর-আবেদাতুল দম্পতির যমজ সন্তানের একজন। ছেলেকেও মা-বাবা জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। অভিযানের সময় এই কিশোর ছুরি নিয়ে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।
গাইবান্ধা জেলা শহরের পাশেই পশ্চিম বাটকামারি গ্রামে সড়কের পাশে তানভীরদের ইটের প্রাচীরঘেরা বাড়ি, আধা পাকা টিনশেড ঘর। এলাকার লোকজনের কাছে শিপার কাদেরী নামে পরিচিত। শিপার তাঁর ডাকনাম। স্থানীয় লোকজন জানান, তানভীর কাদেরীর পরিবারের লোকজন গ্রামের মানুষের সঙ্গে তেমন মেশেন না। অতীতে বিভিন্ন ঈদের সময় তানভীর গাড়ি নিয়ে বাড়িতে আসতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তানভীরের এক সহপাঠী বলেন, তানভীর কোনো রাজনৈতিক দলে যুক্ত ছিলেন না, তবে একসময় শিবিরের রাজনীতি সমর্থন করতেন। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় বলতেন, এ দেশে সঠিকভাবে ধর্ম মানা হয় না।
পুলিশ, এলাকাবাসী ও তানভীরের পারিবারিক সূত্র জানায়, তানভীরের দাদা ছিলেন পাকিস্তানের পেশোয়ারের মানুষ। তিনি এ দেশে বিয়ে করে স্থায়ী হন। তানভীরের বাবা আবদুল বাতেন কাদেরী টিঅ্যান্ডটি বিভাগে চাকরি করতেন। পরে চাকরি ছেড়ে তিনি দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। এখন জর্দার ব্যবসা করেন।
আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে তানভীর ১৯৯৪ সালে গাইবান্ধা সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৬ সালে গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করে ২০০১ সালে প্রথমে কল্লোল গ্রুপে চাকরি নেন। পরে মুঠোফোন কোম্পানি একটেলে (বর্তমানে রবি) যোগ দেন। তারপর তিনি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ২০১৪ সালে হজ থেকে ফিরে চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর আল সাকিনা হোম ডেলিভারি সার্ভিস নামে একটি ব্যবসা শুরু করেন তানভীর।
পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০০১ সালের দিকে তানভীর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইলের ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল তাওয়াতের মেয়ে আবেদাতুল ফাতেমাকে বিয়ে করেন। আবেদাতুল ফাতেমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে সেভ দ্য চিলড্রেনে চাকরি করতেন। তাঁদের যমজ দুই ছেলে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।
গাইবান্ধা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তানভীর কাদেরীর নামে আগে কোনো মামলা ছিল না। তাঁর বিষয়ে জানার জন্য গত সোমবার তাঁর মা-বাবাকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
মারজানের স্ত্রীও আটক: গত শনিবারের ওই অভিযানের ঘটনায় রোববার রাতে তানভীরসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করে লালবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় আটক হওয়া তিন নারী ও উদ্ধার হওয়া তিনটি শিশুর পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
আটক হওয়া অন্য দুই নারীর মধ্যে একজন আফরিন ওরফে প্রিয়তি জঙ্গিনেতা নুরুল ইসলাম ওরফে মারজানের স্ত্রী। পুলিশ এর আগে গণমাধ্যমকে বলেছে, মারজান নব্য জেএমবির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার অন্যতম সমন্বয়ক। তাঁকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। গত জানুয়ারিতে গ্রামের বাড়ি পাবনায় গিয়ে খালাতো বোন প্রিয়তিকে বিয়ে করে এলাকা ছাড়েন মারজান। এরপর থেকেই তিনি নিখোঁজ বলে দাবি পরিবারের।
আটক হওয়া তৃতীয় নারী হলেন শায়লা আফরিন। তিনি জামান ওরফে বাশারুজ্জামানের স্ত্রী। সন্দেহভাজন জঙ্গিদের নিয়ে র্যা ব এর আগে যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে এই বাশারুজ্জামানের নাম ছিল। তাতে বলা হয়, বাশারুজ্জামান গত ৫ জানুয়ারি থেকে নিখোঁজ। পুলিশ বলছে, বাশারুজ্জামানও নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত। বাশারুজ্জামান ও শায়লা আফরিন দম্পতির এক বছরের মেয়ে সাবিহা জামানকেও আজিমপুরের ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটি বর্তমানে অন্য শিশু-কিশোরদের সঙ্গে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছে।
ওই বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া সাত বছরের জুনায়রা নওরিন (পিংকি) হলো ২ সেপ্টেম্বর মিরপুরের রূপনগরে পুলিশের অভিযানে নিহত মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদুল ইসলামের মেয়ে। পুলিশ জানিয়েছে, আজিমপুরের ওই বাড়িতে মেজর জাহিদের স্ত্রী জেবুন্নাহারও (শিলা) থাকতেন। পুলিশের অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে তিনি এক বছরের আরেক কন্যাসন্তানকে নিয়ে সরে পড়েছেন। ওই বাড়ি থেকে জেবুন্নাহার ও তাঁর মেয়ের পাসপোর্ট, মেজর (অব.) জাহিদের সেনা পোশাক পরা ছবি, সেনাবাহিনীতে চাকরির সময় পাকিস্তানের কোয়েটায় প্রশিক্ষণ শেষে পাওয়া সনদ, মিলিটারি সায়েন্স কোর্সের সনদসহ পরিবারটির বেশ কিছু জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল পর্যন্ত জাহিদের স্ত্রীকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। জাহিদের লাশ নেওয়ার জন্যও কেউ আসেনি।