নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের এক বছর

কেউ কথা রাখেনি, খোঁজও নেয় না

নারায়ণগঞ্জে সাত খুন
নারায়ণগঞ্জে সাত খুন

‘এক বছরে কেউ খোঁজ নেয়নি। কেউ কথা রাখেনি। অথচ গত বছরের ২৭ এপ্রিল আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাত খুনের পর দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই সহায়তা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন।’
গতকাল সকালে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন সাত খুনের অন্যতম শিকার মনিরুজ্জামান স্বপনের মা মমতাজ বেগম। ডান পায়ে গুরুতর আঘাত পাওয়া এই বৃদ্ধা অনেক কষ্টে দোতলায় উঠলেন, সেটাই ছিল স্বপনের ঘর। এখন ঘরটিই সন্তানের স্মৃতি ধরে আছে। দেয়ালে টাঙানো স্বপনের বিয়ের ছবিটির দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদলেন। এরপর কিছুটা অভিযোগের সুরে বললেন, ‘ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিএনপির নেত্রী দেখা করে বলেছিলেন সহায়তা করবেন। এসেছিলেন আরও অনেক রাজনীতিক। কিন্তু কেউ কথা রাখেননি।’
জিজ্ঞেস করলাম, এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কেউ এসেছিলেন? বললেন, ‘এমপি সাহেব আসেননি। এলাকার কাউন্সিলর আলী হোসেন আলাও আসেননি। তবে নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন। এখনো নিচ্ছেন।’

মমতাজ বেগম বললেন, ‘আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি, তার পরও তাকে জীবন দিতে হলো। আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’ তাঁর আক্ষেপ, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা ধরা পড়লেও সহযোগীরা ধরা পড়েননি। তাঁর প্রশ্ন, সরকার কেন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনছে না।

নারায়ণগঞ্জ থেকে আদমজী ইপিজেড পাঁচ কিলোমিটার পথ। সেই ইপিজেডের উত্তর দিকে সিদ্ধিরগঞ্জ কদমতলীর ৭ নম্বর ওয়ার্ডে মনিরুজ্জামান স্বপনের বাসা। তাঁর বাবা মোহম্মদ হায়দার আলী খান একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ করে যে দেশ তিনি স্বাধীন করেছেন, সেই দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি তাঁর সন্তানকে কেড়ে নিয়েছে। তিনি এখন অসুস্থ। ভাবলেশহীন চোখে তাকাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ছোট ছেলে, পরিবারের একমাত্র অবলম্বন মিজানুর রহমান খান।

মিজান বললেন, ‘এখন আমাদের একমাত্র চিন্তা ভাইয়ের দুই মেয়েকে নিয়ে। বড় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট মেয়ের বয়স তিন বছর। ভাইয়ের আশা ছিল মেয়েকে ক্যাডেট কলেজে পড়াবেন। সরকার কি ভাইয়ের সেই স্বপ্নটি পূরণ করবে? অন্তত মুক্তিযোদ্ধা কোটায়।’

মনিরুজ্জামানের বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা পথে গেলাম তাঁর গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী নূপুর আক্তারের বাসায়। একান্নবর্তী পরিবারে শাশুড়ি ও ভাশুর-জাদের সঙ্গে থাকেন। একটি তৈরি পোশাক কারখানায় ছয় হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। তাঁর মেয়ে রোজার বয়স ১১ মাস। ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি জানে না, সে পৃথিবীতে আসার আগেই তার বাবাকে ঘাতকেরা খুন করেছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে নূপুর
তাঁর কষ্টের কথা জানালেন। বললেন, ‘দুঃখের কথা ভুলে থাকতে চাই। জীবন তো চালাতে হবে।’ তাঁর আক্ষেপ, পত্রিকার লোকেরা আসেন, কথা বলেন, পত্রিকায় খবর ছাপা হয়, ওই পর্যন্তই। কেউ সাহায্য করেন না। স্বামী মারা যাওয়ার পর কেউই কি সহায়তা করেননি? বললেন, জেলা প্রশাসন থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এরপর সেলিনা হায়াৎ আইভীই খোঁজখবর নেন। দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান। মেয়ে রোজার নামটিও তাঁর দেওয়া।

নূপুর আক্তার বললেন, ‘আমার সন্তানটা বাবার আদরও পায়নি। কীভাবে আমাদের সংসার চলবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন আমরা গণভবনে দেখা করতে যাই, তখন প্রধানমন্ত্রী আমাদের সব দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।’

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে কষ্টের জীবন কাটাচ্ছে আরেক নিহত চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমের পরিবার। ইব্রাহিমের দুই স্ত্রী মাহমুদা ও হনুফা আক্তার পাঁচ সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সোনারগাঁয়ের আলগীর চর গ্রামের বাড়িতে বসবাস করছেন। বাড়িতে পুরোনো কাটা কাপড় সেলাই করে (প্রতি জামা সেলাই এক টাকা) কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছেন।

মাহমুদা বলেন, ‘স্বামী হত্যার এক বছর হয়ে গেল, বিচার পাইনি। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছি না। পুরাতন জামা-কাটা কাপড় সেলাই করে মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকার মতো আয় করতে পারি। সেই টাকা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলছে।’