বাসাবো খেলার মাঠ

খেলার মাঠে 'টাকার মেলা'

এটি খেলার মাঠ। কিন্তু এখানে খেলাধুলার কোনো উপায় নেই। কারণ, মাঠে চলছে তাঁত বস্ত্রমেলা। বাসাবো খেলার মাঠের এই ছবি গতকাল তুলেছেন হাসান রাজা
এটি খেলার মাঠ। কিন্তু এখানে খেলাধুলার কোনো উপায় নেই। কারণ, মাঠে চলছে তাঁত বস্ত্রমেলা। বাসাবো খেলার মাঠের এই ছবি গতকাল তুলেছেন হাসান রাজা

আইন অনুযায়ী খেলার মাঠ খেলা ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার বা ভাড়া দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু এই আইন লঙ্ঘন করেই ও পুলিশের ‘অনুমতি’ নিয়েই বাসাবো খেলার মাঠে আয়োজন করা হয়েছে মাসব্যাপী মেলার। এতে মাঠের পুরো অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় ব্যক্তিরাও বঞ্চিত হচ্ছে খেলাধুলার সুযোগ থেকে।

খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, খেলার মাঠ অন্য কোনোভাবে ব্যবহার বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না৷ এই আইন লঙ্ঘনে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় সাজার বিধান আছে।

গতকাল সোমবার সরেজমিন গেলে স্থানীয় ব্যক্তিরা প্রথম আলোকে বলেন, এবারই প্রথম নয়। এই খেলার মাঠে কয়েক বছর ধরে এমন ছোট-বড় মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। আসলে মেলার মাধ্যমে মাঠ ব্যবহার করে কিছু লোক কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। এটা আসলে টাকার মেলা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চার নম্বর ওয়ার্ড এলাকার এই মাঠটির মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। দেখভাল করার দায়িত্ব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। কিন্তু বাস্তবে মাঠটি পরিচালিত হয় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সমন্বয়ে গঠিত বাসাবো তরুণ সংঘের মাধ্যমে। সংঘটির কার্যালয় মাঠের উত্তর কোনায়, এর সভাপতি সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাস ও সাধারণ সম্পাদক ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুদ হাসান শামীম। এবার এই তরুণ সংঘের নামেই মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। তবে মেলার মূল উদ্যোক্তা শহিদুল ইসলাম ওরফে পিন্টু নামের এক ব্যবসায়ী বলে জানা গেছে।

আয়োজকেরা জানিয়েছেন, মেলার জন্য সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে মৌখিক সম্মতি ও পুলিশের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাঠটির মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর।

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি খেলার মাঠে মেলা আয়োজন সমর্থন করি না। মাঠটি সবার জন্য উন্মুক্ত। মেলার কারণে খেলাধুলা বন্ধ রয়েছে। খেলাধুলা বন্ধ থাকলে এলাকার তরুণেরা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ে।’

মাঠের একাংশে বেঁধে রাখা হয়েছে মহিষ। গতকাল দুপুরের চিত্র l প্রথম আলো

ডিএসসিসির জোন ২-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা আবু নঈম বলেন, ‘এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আমি প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তার কাছে আপত্তির কথা জানিয়েছি। মেলা উচ্ছেদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’ 

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রায় পুরো মাঠ ইট বিছিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। মাঠের চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে ৫১টি স্টল বানানো হয়েছে। মাঠের ভেতরেও রয়েছে অন্তত ২০টি স্টল। মেলা উপলক্ষে মাঠের মধ্যে থ্রি-ডি শো থেকে শুরু করে চরকি দোলনা, ট্রেন রাইডসহ নানা বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাঠের মূল প্রবেশমুখের সামনে ইট দিয়ে প্রায় স্থায়ী অবকাঠামোর মতো স্থাপনা বানিয়ে করা হয়েছে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা। মাঠের ঠিক মাঝখানে রয়েছে বড় একটি টাওয়ার।

নামে তাঁত বস্ত্র মেলা হলেও এখানে রয়েছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, জুতা থেকে শুরু করে গৃহসজ্জার উপকরণ, কার্পেট, হাঁড়ি-পাতিল, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, কসমেটিকস, খাবার দোকানসহ নানা পণ্যের স্টল। আছে ম্যাজিক দেখা ও শেখার স্টলও। 

মাঠটির উত্তর দিকে পাশাপাশি তিনটি ভবন। এর একটিতে ব্যায়ামাগার ও আরেকটিতে কারাতে শেখানো হয়। অন্যটি তরুণ সংঘের কার্যালয়। এই তিন ভবনের সামনে প্রায় ২৫-৩০ ফুট জায়গা ফাঁকা। এরপর থেকে খেলার মাঠের সীমানা শুরু। গতকাল দুপুরে মাঠের সীমানা ও ভবন তিনটির মাঝের ফাঁকা জায়গায় ১৫-২০টি মহিষ বেঁধে রাখতে দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দোকানি জানিয়েছেন, মেলার মূল আয়োজক শহিদুল ইসলাম ওরফে পিন্টু। পিন্টুর মাধ্যমে তাঁরা স্টল বরাদ্দ নিয়েছেন। স্টলপ্রতি ভাড়া ধরা হয়েছে ৪২ হাজার ৫০০ টাকা। গত ২৪ জুলাই মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

মেলার আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে গতকাল শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জামদানি শাড়ির ব্যবসা করেন। সিলেটে একটি মেলায় তাঁর কাপড়ের স্টলে তিনি আছেন। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় থাকায় তরুণ সংঘের লোকজন তাঁকে মেলা সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের জানাতে অনুরোধ করেছিলেন। তাই তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্টলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি মেলার আয়োজক নন। বাসাবো তরুণ সংঘই আয়োজক। মেলায় প্রায় ৮০টির মতো স্টল আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

তাঁত বস্ত্রমেলার কারণে এই হাল মাঠের। গতকাল তোলা ছবি l প্রথম আলো

তরুণ সংঘের সভাপতি লায়ন চিত্ত রঞ্জন দাসের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বল্প মূল্যে স্থানীয় ব্যক্তিদের পণ্য কেনার সুযোগ, সময়ের অপচয় রোধ ও তরুণ সংঘের আর্থিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। তাঁর দাবি, প্রতিবছর এই সময় বৃষ্টি থাকে। বৃষ্টির সময় এলাকার ছেলেরা খেলতে আসেন না। তাই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলা হলে মাঠের কোনো ক্ষতি হয় না দাবি করে তিনি বলেন, মেলা শেষে মাঠের যে সংস্কার করা হয় তাতে মাঠ আগের চেয়ে আরও ভালো হয়। তাই খেলার মাঠে মেলার আয়োজন দোষের কিছু নয়।

তবে স্থানীয় একাধিক তরুণ প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা নিয়মিত এই মাঠে খেলাধুলা করতেন। কিন্তু মেলার প্রায় এক মাস আগে থেকে খেলাধুলা বন্ধ। আবার কবে তাঁরা খেলতে পারবেন জানেন না।

তরুণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ হাসান শামীম বলেন, তরুণ সংঘের একটি ফুটবল দল আছে। দলটি প্রথম বিভাগে খেলে। এ দলের পেছনে প্রতিবছর প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়। এই টাকা তুলতেই মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলা আয়োজন করতে সিটি করপোরেশনের মৌখিক অনুমতি ও পুলিশের লিখিত অনুমতি নেওয়া হয়েছে।

পুলিশের অনুমতি সম্পর্কে জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার আনোয়ার হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে পুলিশ কমিশনার মেলার অনুমতি দেন। অনুমতি আছে কি নেই তা সংশ্লিষ্ট থানা বলতে পারবে।

সবুজবাগ থানায় যোগাযোগ করা হলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কুদ্দুছ ফকির বলেন, তরুণ সংঘের ফুটবল দলের পাশাপাশি কুটিরশিল্পের উন্নয়নের জন্য শর্তসাপেক্ষে মেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আইন লঙ্ঘন করে কীভাবে মেলার অনুমতি দেওয়া হলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে দুই-তিন দিন আগে মেলা উচ্ছেদে সহযোগিতা চেয়ে একটি চিঠি এসেছে। সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ করতে এলে তাদের সহযোগিতা করা হবে।