
রহিমা খাতুনের চারটি ছাগল মারা গেলে তিনি ঠুকে দেন নালিশি মামলা। মামলায় ১০টি ছাগল হত্যার অভিযোগ আনেন তিনি। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তে রহিমার করা অভিযোগের সত্যতা পায়নি পিবিআই।
বিষ প্রয়োগে ১০টি ছাগল হত্যার অভিযোগে গত ২০ জানুয়ারি খুলনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১২ জনের বিরুদ্ধে নালিশি মামলা করেন রূপসার হোসেনপুরের বাসিন্দা রহিমা।
নালিশি মামলায় রহিমা আরও অভিযোগ করেন, বিবাদীরা তাঁর বাসায় ঢুকে তাঁকে মারধর করেছেন, হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
নালিশি মামলায় যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তাঁদের মধ্যে ছয়জন রহিমার নিকটাত্মীয়। বাকি ছয়জনের মধ্যে তিনজন তাঁর প্রতিবেশী। অন্য তিনজন গ্রামের বাসিন্দা।
আদালত নালিশি মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। তদন্ত শেষে ৩ এপ্রিল আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন খুলনা জেলা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আমান উল্লাহ।
আদালতে দেওয়া পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রহিমার করা অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
পিবিআই সূত্রের ভাষ্য, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে রহিমা তাঁর ছাগল মারা যাওয়ার বিষয়টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নালিশি মামলাটি করেন বলে মনে হয়।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে রহিমার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর দুজন স্বজনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তাঁদের মাধ্যমেও রহিমার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
রহিমা মুঠোফোন ব্যবহার করেন না বলে দাবি করেন তাঁর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে মাহবুব রহমান ঢালী। রহিমার নালিশি মামলায় তাঁর পক্ষের অন্যতম সাক্ষী মাহবুব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবারই প্রথম নয়, বছরের বিভিন্ন সময় রহিমার ছাগল মারা যায়। কারণ, তিনি ঠিকভাবে ছাগলগুলো লালন-পালন করেন না। তিনি নালিশি মামলায় যে অভিযোগ করেছেন, তা ঠিক নয়।’
নালিশি মামলার অভিযোগে রহিমা বলেন, তিনি প্রায় ২০ বছর আগে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিতে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। মাদ্রাসাটি তিনি নিজেই পরিচালনা করছিলেন। তাঁর প্রতিপক্ষরা পাশে আরেকটি মাদ্রাসা নির্মাণ করে রহিমার মাদ্রাসাটি বন্ধ করার হুমকি দেয়। একপর্যায়ে তাঁর মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। মাদ্রাসা বন্ধের জন্য তিনি বিবাদীদের দায়ী করেন।
রহিমা গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন উল্লেখ করে অভিযোগে বলেন, মাদ্রাসা-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে বিবাদীরা তাঁর ক্ষতির চেষ্টা করে আসছিলেন। গত বছরের ১০ নভেম্বর বিবাদীরা তাঁর একটি ছাগলের বাচ্চা চুরি করেন। তিন দিন পর ১৩ নভেম্বর তাঁর খামারে বিবাদীরা হামলা করেন, ভাঙচুর চালান। বাধা দিলে তাঁকেও মারধর করা হয়। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি বিবাদীরা পারস্পরিক যোগসাজশে তাঁর খামারে ঢুকে ছাগলের খাবারে বিষ প্রয়োগ করেন। এতে তাঁর ১০টি ছাগল মারা যায়।
তবে পিবিআইয়ের তদন্তে রহিমার এমন অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। আদালতে দেওয়া পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রহিমার বাড়িতে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। তাঁকে কেউ মারধরও করেননি। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁর চারটি ছাগল মারা যায়। ছাগলগুলো তিনি গর্ত করে পুঁতে রাখেন।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিসেরা পরীক্ষার জন্য আলামত সংগ্রহের লক্ষ্যে গত ১০ মার্চ রূপসার পশুচিকিৎসক টুকু কুমার সাহার উপস্থিতিতে তদন্ত কর্মকর্তা ছাগল চারটির মৃতদেহ উত্তোলনের চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘটনার দুই মাস অতিবাহিত হওয়ায় ছাগল চারটির মৃতদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। এ কারণে ভিসেরা নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি।
এ বিষয়ে রূপসার পশুচিকিৎসক টুকু কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৃত ছাগলগুলো পচে এমনভাবে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, তা আর পরীক্ষা করার মতো অবস্থায় ছিল না। পরীক্ষা করতে না পারায় এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার সুযোগ ছিল না।’
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছরই রহিমার খামারের কিছু ছাগল মারা যায়। তিনি যে ঘরে ছাগল রাখেন, সেটি খুবই ছোট ও স্যাঁতসেঁতে। এই ঘর ছাগল পালনের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। কোনো ছাগল রোগাক্রান্ত হলেও তিনি কখনো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতেন না।
তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আমান উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়িতে গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি পালন করেন রহিমা। তবে তিনি সেগুলোর যত্ন নেন না। নিয়মিত খাবারও দেন না। এ কারণে প্রতিবছরই রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল মারা যায়।’
আমান উল্লাহ বলেন, অনেক সময় রহিমার গরু-ছাগল অন্যের ফসল নষ্ট করে। এ নিয়ে আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হয়। এ ছাড়া রহিমা তাঁর প্রতিষ্ঠা করা মাদ্রাসা বন্ধের জন্য বিবাদীদের দায়ী করেন। এসব বিরোধকে কেন্দ্র করেই তিনি তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আদালতে নালিশি মামলা করেন।