Thank you for trying Sticky AMP!!

সেই মগের মুল্লুকের মগদের ধরবে কে

মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন ফরাসি পরিব্রাজক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ে। এক যুগ ভারতবর্ষে কাটিয়ে তিনি লিখে গেছেন বার্নিয়েরস ট্রাভেলস ইন দ্য মোগল অ্যাম্পায়ার। মধ্যযুগের সেরা ইতিহাসের সেই বইতে আছে রক্ত হিম হয়ে আসা মগ দস্যুদের কালো সন্ত্রাসের কাহিনি। বার্নিয়ে দেখেছেন, আরাকান বা আজকের মিয়ানমার থেকে আসা মগ দস্যুদের অত্যাচারে গ্রামের পর গ্রাম মানুষশূন্য হয়ে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম জয় করার পর মগদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করেন। কিন্তু ‘মগের মুল্লুক’ শব্দটি বাঙালির ঘাড়ে রয়ে যায় সাড়ে তিন শ বছর ধরে।

ফরিদপুরে দুই ভাইয়ের তাণ্ডব নিয়ে গত ২৮ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘সন্ত্রাসীদের হাতে রাজনীতির চেরাগ’ শিরোনামের প্রতিবেদন পড়ে সেই প্রশ্ন তুলেছেন এক পাঠক। তাঁর জিজ্ঞাসা, এত দিন ফরিদপুর কি মগের মুল্লুক ছিল? পাঠকের সেই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা নেই। আরেক পাঠকের মন্তব্য, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, থানা, ইউনিয়নে একই ঘটনা ও উদাহরণ পাওয়া যাবে। এই দুর্বৃত্তায়নের শিকড় অনেক গভীরে। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথও সহজ নয়। যেন গভীর অন্ধকারময় সময় অতিক্রম করছি আমরা।’

এত দিন সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে হেন অপকর্ম নেই, যা ফরিদপুরে হয়নি। সবকিছুই ঘটেছে ক্ষমতার বলয়ের প্রভাব খাটিয়ে। যারা এসব করেছে তাদের হিসাবে হয়তো কিছু ত্রুটি ছিল। যে কারণে তাদের কুৎসিত রূপটি এখন বেরিয়ে আসছে। এরপর আবার কেউ যদি একই ভুল করে, হয়তো তার পরিণতিও এমনই হবে। কিন্তু যাদের হাত ধরে এদের উত্থান, তারা কি পর্দার অন্তরালেই থেকে যাবে? যারা এত দিন নানাভাবে তাদের সহায়তা করেছে, তারা? ফরিদপুরের সাধারণ মানুষের দাবি, বরকত–রুবেলদের সহযোগী ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকদেরও আইনের আওতায় আনা হোক। তাঁদের বিচারের আওতায় আনা হলে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে।

ফরিদপুরের রাজনীতির অন্ধকার আপাতত কিছুটা হলেও কেটে গেছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনায় প্রথমে গ্রেপ্তার হন শহর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, ফরিদপুর পৌরসভা বর্ধিত ২৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান, শহর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদিক বন্যা মণ্ডল, কোতোয়ালি স্বেচ্ছাসেবক লীগ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হামিদুর রহমান, ১৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নারায়ণ চক্রবর্তীসহ ১৩ জন। এঁরা সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। 

ঈদের ছুটির সময় গ্রেপ্তার হন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার ওরেফে লেবি, জেলা শ্রমিক লীগের কোষাধ্যক্ষ বিল্লাল হোসেন ও শহর যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসিবুর রহমান ওরফে ফারহান। নতুন যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, হয়তো তাঁরাও সব স্বীকার করবেন। আগের স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে ফরিদপুরের সন্ত্রাসের এক বীভৎস চেহারা। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে জনপ্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসনের আরেক কদর্য রূপ। দিনের পর দিন যাঁরা অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁদের আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে আর সন্ত্রাসীদের সমাদর করেছে পুলিশ।

অভিযোগ নিয়ে মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গেলে তারা সেটা গ্রহণ না করে বসে বসে হিসাব-নিকাশ করেছে কার অভিযোগ নেবে, আর কারটা নেবে না। এটা আইনের স্পষ্টত বরখেলাপ। তাহলে, যাঁরা এসব করেছেন তাঁরা কেন আইনের আওতায় আসবেন না?

বরকত–রুবেলের সাত–আট বছরের তাণ্ডবের সময় ফরিদপুরে চারজন পুলিশ সুপার ছিলেন। জাকির হোসেন, সুভাস চন্দ্র সাহা, আওলাদ হোসেন ও জামিল হাসান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন ছিলেন জামিল হাসান। একজন ছাড়া সবাই এখন বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তাহলে সেই সময়ের পরিস্থিতির জন্য তাঁরা কেন দায়ী হবেন না?

শুধু পুলিশ সুপার নন, সে সময় কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্ব পালন করেছেন আরও কয়েকজন। শহরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ছিল দলীয় কর্মীর মতো। কে কোন কমিটিতে থাকবেন, সেটাও নাকি ঠিক করে দিতেন এক পুলিশ সুপার। আরেক পুলিশ সুপার সুভাষ চন্দ্র সাহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় ৮ কোটি টাকা উপার্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছিল। সেই মামলার পর থেকে তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত আছেন।

সাধারণ মানুষের অভিযোগ, প্রশাসনের সহায়তা বা নীরবতায় সন্ত্রাসীরা দিনে দিনে ফরিদপুর জেলা বাস মালিক সমিতি, ডায়াবেটিক সমিতি, ফরিদপুর চেম্বার, জেলা ক্রীড়া সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, এমনকি ডা. জাহিদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালের পরিচালনা কমিটির পদও দখল করেছেন। তাঁরা এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য, সড়ক ও জনপথ, শিক্ষা প্রকৌশল, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইডব্লিউটিসি, গণপূর্ত, বিআরটিএ, বিদ্যুৎ অফিস, বিএডিসি, পাসপোর্ট অফিস এবং শহরের ফুটপাত নিজের কেনা তালুকের মতো দখলে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, চাঁদাবাজি করেছেন। কেউ এসব দেখেও দেখেনি। তাহলে প্রশাসনের কাজটা কী? প্রশাসন থাকার দরকারই–বা কী?

বরং কোথাও থানা-পুলিশ, কোথাও জেলা পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে দুর্বৃত্তরা রাজত্ব করেছে। তারা আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের শহরছাড়া করেছে। যাঁরা দলের জন্য নিবেদিত ছিলেন তাঁরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন মামলার আসামি হয়ে, জেলে থেকেছেন দিনের পর দিন।

সাবেক মন্ত্রীর এপিএস এ এইচ এম ফোয়াদের হেলমেট বাহিনী আর বরকতের হাতুড়ি বাহিনী যখন মোটরসাইকেল নিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়াত, তখন সাধারণ মানুষ ভয়ে ঘরে ঢুকেছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং মজা দেখেছে। শুধু তা–ই নয়, নিরীহ মানুষের জমি দখলে পুলিশ সেজেছিল জমিদারের লাঠিয়ালের ভূমিকায়। তাহলে তাদের কেন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না? বরকত–রুবেলেরা যদি অপরাধ করে থাকেন তাহলে তাঁরা কি ধুয়া তুলসীপাতা?

একই অভিযোগ জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধেও। ওই সময়ে চারজন জেলা প্রশাসক ফরিদপুরে দায়িত্ব পালন করেছেন। উম্মে সালমা তানজিয়া, সরদার শরাফত আলী, আবু হেনা খন্দকার মোর্শেদ জামান ও হেলাল উদ্দিন। এঁদের মধ্যে মোর্শেদ জামান ভালো মানুষের পরিচিতি পেয়েছিলেন। সে কারণে সাত মাসের মাথায় তাঁকে বিদায় নিতে হয়। বাকিরা কী করলেন? তাঁরাও দুর্বৃত্তদের হয় সহায়তা করেছেন, নয় তো নীরব থেকেছেন। এক জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে তো চর দখলে সহায়তার অভিযোগ ছিল। আরেকজন নাল জমিকে (ফসলি সমতল ভূমিকে নাল জমি বলে) রাতারাতি বাণিজ্যিক জমি হিসেবে দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের বেশি টাকা পাইয়ে দেন। সেই টাকা সাধারণ কোনো মানুষের ঘরে যায়নি, গেছে সন্ত্রাসীর ঘরে। এমন হাজারও অপকর্মে সহায়তা বা নীরব থাকার অভিযোগ আছে কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সব অন্যায়–আবদার কি প্রশাসনের কর্মকর্তারা নতজানু হয়ে মেনে নেবেন? তাঁরা রাষ্ট্রের নাকি দলের হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন, সেটা গুলিয়ে ফেলার কারণেই এই সমস্যা।

ফরিদপুরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সন্ত্রাসী বা গডফাদারদের ওপর তারা যেমন ক্ষুব্ধ, তেমনি ক্ষুব্ধ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ওপরও। অভিযোগ, এঁদের কেউ কেউ হয়তো অবৈধ অর্থের ভাগও পেতেন। অথচ তাঁরা রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব কর্মকর্তার সুবিধা হলো, তাঁরা এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না। যখন ঘটনা জানাজানি হতে থাকে, তখন তাঁদের টিকিটিও দেখা যায় না।

স্থানীয় মানুষের আশঙ্কা, এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে কিছুদিন পর দেখা যাবে, অদৃশ্য কারণে সবকিছুই থেমে গেছে। এখন যাঁরা অভিযোগ করেছেন, তখন তাঁরাই বিপদে পড়বেন। এ যেন আলো-আঁধারির খেলা। কারণ, ঘৃণ্য এই ঢেউ থিতিয়ে গেলে রাজনীতিক, পুলিশ প্রশাসনের হর্তাকর্তা সবারই আবার দরকার হবে নতুন বরকত, নতুন রুবেলদের!

আরও পড়ুন:-
বরকত-রুবেল থাবা বিস্তার করে ১০ জেলায়
সন্ত্রাসীদের হাতে রাজনীতির ‘চেরাগ’