দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই কারাগার—কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও গাজীপুরে অবস্থিত কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার। প্রভাবশালী ও দুর্ধর্ষ বন্দীও বেশি এই দুই কারাগারে। কড়া নিরাপত্তা ও নজরদারিও এই দুটিতে বেশি থাকার কথা। অথচ এই দুই কারাগারের অনেক বন্দী অবৈধভাবে মুঠোফোন ব্যবহার করে বাইরের মাদক কারবার, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক নির্দেশনাও দেন। এমনকি কারাগার ভেঙে পালানোর মতো পরিকল্পনাও করেছিল দুর্ধর্ষ আসামিদের কেউ কেউ।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকেও দেওয়া হয়েছে।
কয়েক মাস আগে দেওয়া এসবির এই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, দেশের অন্যতম প্রধান এই দুটি কারাগারের বন্দীরা অবৈধভাবে অন্তত ৩৬০টি মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৭৯টি ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ২৮১টি মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার হচ্ছে। কারাগারকে মুঠোফোনে অপরাধ ও অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের নিরাপদ স্থান হিসেবে তৈরির পেছনে কতিপয় অসাধু কারা সদস্যের যোগসাজশ রয়েছে।
শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে বা নানা কৌশলে খুবই ছোট আকারের কিছু ফোন ভেতরে ঢুকছে। একশ্রেণির অসাধু কারারক্ষী এবং পুরোনো কিছু বন্দী এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন, কারা মহাপরিদর্শক
এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার (কেরানীগঞ্জ) এবং কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের ওপর তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি করে এসবি। এ জন্য কারাগার দুটির সঙ্গে সংযুক্ত এবং পার্শ্ববর্তী বেস ট্রান্সসিভার স্টেশনের (মুঠোফোনের কল গ্রহণ-প্রেরণ কেন্দ্র) আওতাধীন এলাকা থেকে তথ্য (ডেটা) সংগ্রহ করা হয়। এভাবে সংগ্রহ করা ২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৫২টি মুঠোফোন নম্বর বিশ্লেষণ করে কারাগারের অভ্যন্তরে অবৈধভাবে নিয়মিত ব্যবহৃত হয় এমন ৩৬০টি নম্বর চিহ্নিত করা হয়। অবৈধ মুঠোফোন নম্বর সরবরাহ প্রক্রিয়ায় যুক্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।
এসবির তথ্য ধরে প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও মিলেছে কারাগার থেকে এমন কার্যক্রম পরিচালনার খবর। এর মধ্যে টাকার বিনিময়ে কেউ কেউ সার্বক্ষণিক মুঠোফোন রাখছেন। আবার কেউ কেউ যখন চান, তখনই বাইরে মুঠোফোনে কথা বলতে পারেন। কাশিমপুর কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় এক আসামি তাঁর মামলার বাদীকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় ঢাকার একটি থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) হয়েছে।
এ ছাড়া কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী ও আলোচিত অপরাধীদের কেউ কেউ মুঠোফোনে বাইরের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকনির্দেশনা দেন—এমন অভিযোগ অনেক পুরোনো। উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত বন্দীরাও মুঠোফোন ব্যবহার করার বিষয়টিও বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছিল।
কেবল সরাসরি মুঠোফোন নম্বরেই নয়, ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধাসংবলিত ফোন থেকে বিভিন্ন অ্যাপস দিয়ে বাইরে যোগাযোগের ঘটনাও ঘটছে বলে এসবির প্রতিবেদনে এসেছে।
টাকার বিনিময়ে কেউ কেউ সার্বক্ষণিক মুঠোফোন রাখছেন। আবার কেউ কেউ যখন চান, তখনই বাইরে মুঠোফোনে কথা বলতে পারেন। কাশিমপুর কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় এক আসামি তাঁর মামলার বাদীকে হত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় ঢাকার একটি থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) হয়েছে।
উল্লিখিত দুই কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ছয় মাসে জামিন পেয়ে বের হয়েছেন, এমন এক নারীসহ সাতজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা জানান, নিয়মানুযায়ী সপ্তাহে এক দিন কারা কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নম্বরে কথা বলার সুযোগ দেয়। তবে টাকা খরচ করলে অন্য সময়েও কারাগার থেকে মুঠোফোনে কথা বলা যায়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলে মাঝেমধ্যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কিছুদিন গেলে অবস্থা আগের মতোই হয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারামুক্ত এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, বন্দীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন সেলের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি ও কিছু কারারক্ষী টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে ফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেন। কোনো ক্ষেত্রে ৫০০ টাকা দিলেই ১০-১৫ মিনিট পর্যন্ত কথা বলা যায়। এ জন্য কখনো পিসি কার্ড (কারাগারে কেনাকাটার জন্য টাকা জমার কার্ড) থেকে টাকা নিয়ে নেয়। কখনো আবার সিগারেটের প্যাকেটের বিনিময়েও কথা বলা যায়।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এমন উদাহরণও আছে, বিগত আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছর কারাগারে থেকেই ফোনে বাইরে যোগাযোগ রেখে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। যিনি কারাবাসের এই দীর্ঘ সময়ে বাইরের পছন্দের খাবার খেয়েছেন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে অবৈধ মুঠোফোন ব্যবহারের ঘটনাগুলো নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন অংশে লুকিয়ে বা নানা কৌশলে খুবই ছোট আকারের কিছু ফোন ভেতরে ঢুকছে। অনেক সময় স্ক্যানারেও তা ধরা পড়ছে না। একশ্রেণির অসাধু কারারক্ষী এবং পুরোনো কিছু বন্দী এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।
দুই কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে গত ছয় মাসে জামিন পেয়ে বের হয়েছেন, এমন এক নারীসহ সাতজনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা জানান, নিয়মানুযায়ী সপ্তাহে এক দিন কারা কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নম্বরে কথা বলার সুযোগ দেয়। তবে টাকা খরচ করলে অন্য সময়েও কারাগার থেকে মুঠোফোনে কথা বলা যায়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হলে মাঝেমধ্যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কিছুদিন গেলে অবস্থা আগের মতোই হয়ে যায়।
জামিনে বের হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারাগারে সরাসরি নগদ টাকা ব্যবহারের সুযোগ নেই। এ জন্য কারাগারের পুরুষ সেলগুলোতে বিভিন্ন অবৈধ কাজে সিগারেটের প্যাকেটকে মুদ্রার মতো করে ব্যবহার করা হয়। সেখানে হলিউড সিগারেটের প্যাকেট ১৬০ টাকা, গোল্ডলিফ ৩০০ টাকা এবং বেনসন ৪০০ টাকা হিসেবে ব্যবহার হয়। পিসির মাধ্যমে সিগারেট কিনে পরে এগুলো না খেয়ে অবৈধ সুবিধার জন্য কারারক্ষী ও সেলের দায়িত্বে থাকা বন্দীদের দেন।
অবশ্য কারা মহাপরিদর্শক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেছেন, লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে সিগারেটের ব্যবহার বন্ধে উচ্চ মূল্যের সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এসবির প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু অসৎ কারারক্ষী উল্লেখিত কাণ্ডে (মুঠোফোন ব্যবসা) জড়িত ছিলেন। তাঁরা কয়েদিদের মুঠোফোন সরবরাহ এবং সার্বিক সহযোগিতা করতেন। এমন কাণ্ডে জড়িত কিছু পুরোনো কয়েদি ও কারাগারে কর্মরত নয়জনের নাম এসেছে প্রতিবেদনে।
এই ৯ ব্যক্তির কেউ কেউ কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের সংলগ্ন একটি মহিলা কারাগারসহ তিনটি কারাগারে কর্মরত আছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
কাশিমপুরের মোট চারটি কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারে ৯ থেকে ১০ হাজার বন্দী থাকেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার দুর্ধর্ষ ও আলোচিত বন্দীদেরও নানা কারণে এখানে এনে রাখা হয়।
আর কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৯ হাজারের বেশি বন্দী আছেন। এর মধ্যে ১৩০ জন ফাঁসির আসামি।
এই কারাগার থেকে সম্প্রতি জামিনে বের হওয়া এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, সিগারেটের প্যাকেট দিলে সব ম্যানেজ হয়ে যায়। কারারক্ষী, ইনচার্জ (সেলের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা কয়েদি) এবং ফোন রাইডারের (বৈধ ফোন সুবিধা পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েদি) যোগসাজশেই সব হয়। তবে নিয়মিত কাছে মুঠোফোন রাখতে চাইলে বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়।
কারাগারের পুরুষ সেলগুলোতে বিভিন্ন অবৈধ কাজে সিগারেটের প্যাকেটকে মুদ্রার মতো করে ব্যবহার করা হয়। সেখানে হলিউড সিগারেটের প্যাকেট ১৬০ টাকা, গোল্ডলিফ ৩০০ টাকা এবং বেনসন ৪০০ টাকা হিসেবে ব্যবহার হয়।
তবে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার সূত্র জানায়, গত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত কারাগার থেকে ৯৭টি মুঠোফোন উদ্ধার হয়েছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে উদ্ধার হয়েছে ৭০টির ওপরে। এ ঘটনা বিশ্লেষণ করে তারা দেখেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পায়ুপথে বিশেষ কায়দায় ছোট আকারের মুঠোফোনগুলো কারাগারে নিয়ে আসেন বন্দীরা। এমন একটি ঘটনা পাওয়া গেছে, যেখানে এক বন্দী একসঙ্গে দুটো মুঠোফোন পায়ুপথে নিয়ে এসেছেন। আবার একজন একই কায়দায় মুঠোফোন এনে সেটি বের করতে না পারায় পরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে সেটি বের করতে হয়েছে।
কারাগার সূত্র জানিয়েছে, আরেকটি কৌশল হলো—বাইরে থেকে মাদক ও মুঠোফোন বিশেষ কায়দায় পেঁচিয়ে বলের মতো করে ভেতরে নিক্ষেপ করা। এই কাজেও কারা অভ্যন্তরে দায়িত্বরত কতিপয় ব্যক্তির সহযোগিতা থাকে।
এসবির প্রতিবেদনে বলা হয়, অসাধু কারারক্ষী বা কর্মচারীরা অর্থের বিনিময়ে মোবাইল ফোন সেট ও সিম কয়েদিদের কাছে পৌঁছে দেয়। এ ছাড়া খাবার, ওষুধ, জুতা বা উপহারের মধ্যে মোবাইল সেট ও সিম কৌশলে কয়েদিদের কাছে পৌঁছানো হয়।
হাইসিকিউরিটি কারাগার সূত্র বলছে, সেখানে বন্দীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য কাজে ৩০০ জনের মতো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত। এঁদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন বিভিন্ন ধরনের অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন সময় অপরাধের ঘটনায় ধরা পড়ায় অনেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। সম্প্রতি এক কারারক্ষী অন্তর্বাসের ভেতরে মাদক নিয়ে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ মামলা করা হয়েছে। তবু একশ্রেণির কারা সদস্য নানা কৌশলে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন প্রথম আলোকে বলেন, বডি স্ক্যানার মেশিনটি নষ্ট থাকায় বিভিন্ন কৌশলে কিছু মুঠোফোন কারাগারে ঢুকেছে। আবার এখানে কর্মরত কেউ এ কাজে সহযোগিতাও করে থাকতে পারে। তবে অভিযান চালিয়ে মুঠোফোনগুলো জব্দ করা হচ্ছে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের প্রতিবেদন পেলে এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শৌচাগারের নিচু কমোডের ভেতরে ছোট ফাটল তৈরি করে বিশেষ কায়দায় ফোন রাখা হয়। অনেক সময় কমোডের ফ্লাশের পাইপে পলিথিন মুড়িয়েও ফোন রাখা হয়।
এসবির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বন্দীরা অনিয়মিতভাবে একই মোবাইল সেট বা সিম বিভিন্ন হাত বদলের মাধ্যমে ব্যবহার করছেন। বন্দীরা সাধারণত নিজেকে কাপড়ে ঢেকে, শৌচাগার, গোসলখানায় গিয়ে বা অন্য কোনোভাবে চুপিসারে কথা বলে থাকেন। কোনো বন্দী মুক্তি পেলে বা অন্য কারাগারে চলে গেলে মুঠোফোন সেট ও সিম পরিচিত অন্য কোনো বন্দীকে দিয়ে যান।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শৌচাগারের নিচু কমোডের ভেতরে ছোট ফাটল তৈরি করে বিশেষ কায়দায় ফোন রাখা হয়। অনেক সময় কমোডের ফ্লাশের পাইপে পলিথিন মুড়িয়েও ফোন রাখা হয়। আবার মোজার মধ্যে ফোন রেখে সেটি দড়ি দিয়ে বেঁধে জানালার বাইরের অংশে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনাও আছে।
সরকারকে দেওয়া পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসেছে, আলোচিত (হাই-প্রোফাইল) বন্দীরা মুঠোফোন নিজেদের কাছে না রেখে অন্য কোনো বন্দীর কাছে রাখেন। কেউ কেউ দেয়ালে কুঠুরি করে, পলিথিনে পেঁচিয়ে টয়লেটের মধ্যে মুঠোফোন লুকিয়ে রাখেন।
কেরানীগঞ্জ ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের একাধিক সূত্র বলছে, প্রতি মাসেই মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়। নিয়মিত তল্লাশিও করা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যখন তল্লাশি শুরু হয় তখন কতিপয় কারা সদস্য এগুলো এক সেল থেকে অন্য সেলে নিয়ে যান। ফলে কিছু মুঠোফোন থেকেই যায়। যখন ধরা পড়ে, তখন ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলেন, জামিনে বের হওয়া কোনো বন্দীর থেকে মুঠোফোনটি তিনি পেয়েছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেতরে মোবাইল ফোন ব্যবহার হয়, এটা অস্বীকার করা যাবে না। এর সঙ্গে এখানে কর্মরত কেউ কেউ হয়তো জড়িত আছেন। তবে অভিযান চালিয়ে এটাকে অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে মূল সমস্যা হলো মুঠোফোন সরবরাহকারীদের শনাক্ত করতে না পারা। আমরা এখন সেই দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’
গত নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি সূত্র জানায়, তখন সেখানে ২ হাজার ৮০০–এর মতো বন্দী ছিলেন। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী ছিলেন ১ হাজার ২৩৩ জন। কারাগার-সংক্রান্ত বেশির ভাগ অপরাধে এবং অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির নাম বেশি আসে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক কয়েদিরা কারাগার ভেঙে পলায়নের চেষ্টা করেছেন বলেও এসবির প্রতিবেদনে এসেছে। তাতে বলা হয়, কারাগারের আটক পতিত সরকারের নেতা-কর্মীরা কারাগার ভেঙে পলায়নের পরিকল্পনা করেন। গত আগস্টে বাইরে থাকা নেতা-কর্মীরাও বিভিন্ন কারাগার আক্রমণ করবেন বলে পরিকল্পনাও ছিল।
এসবি ও কারাগার সূত্র জানায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী, কারাগারে আটক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভেতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কথা ছিল। এই পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার জন্য অন্য বন্দীদের উসকানি দেওয়া হয়। এরই মধ্যে হাই সিকিউরিট কারাগারের তিনজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী কারাগারের জানালা ভেঙে দড়ি বেয়ে পালানোর পরিকল্পনা করেন। এরই অংশ হিসেবে কম্বল ছিঁড়ে দড়ি বানিয়ে নিচতলার শৌচাগারের টাইলস সরিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়তে থাকেন তাঁরা। প্রতি রাতে একটু একটু গর্ত করে সুড়ঙ্গটি এতটা বড় করা হয়, যেখানে একজন মানুষ ঢুকে যেতে পারে। তবে কারাগারের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ধরে ফেললে তাঁরা পালাতে ব্যর্থ হন। এ ঘটনার পর নিচতলার মেঝের থেকে টাইলস উঠিয়ে সিমেন্ট-বালুর প্রলেপ দিয়ে দেওয়া হয়।
এসবির প্রতিবেদনে আরও এসেছে, কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের অনেকে অবৈধভাবে মুঠোফোন ব্যবহার করে বাইরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, নানা নির্দেশ দিচ্ছেন।
অবৈধভাবে ব্যবহার হওয়া মুঠোফোন নম্বরগুলোতে নজরদারি চালিয়ে পুলিশের বিশেষ শাখা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। এতে কারাগার থেকেই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ পরিচালনা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে—এমন কথাও এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, উল্লিখিত দুই কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে বাইরে অস্ত্র রয়েছে। সেগুলো ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যার মতো কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁরা কারাগারের ভেতরে থাকা অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন।
এ ছাড়া কারাবন্দী কোনো কোনো মাদক কারবারি বাইরের মাদক ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কারাগারে বসে বাইরের অনুসারীদের দিয়ে হত্যার পরিকল্পনার ঘটনাও রয়েছে। এ ছাড়া অসৎ কারারক্ষীদের সহায়তায় কারাগারের ভেতরেও মাদক প্রবেশের ঘটনাও আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে নজরদারির ঘাটতি থাকায় বাইরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এর প্রভাব পড়ে। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং মগবাজার-গুলশান-বাড্ডাকেন্দ্রিক কয়েকটি ঘটনায় বিষয়টি বিশেষভাবে সামনে আসে। কারাবন্দী আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বাইরের অপরাধ পরিচালনা নিয়ে বিভিন্ন সময় অনেক খবরও বেরিয়েছে।
কয়েদিদের কাছে ফোন সেট ও সিম সরবরাহকারী অসৎ কারারক্ষী ও কর্মচারীদের শনাক্ত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এসবি যেসব মুঠোফোন নম্বর শনাক্ত করেছে, সেগুলোর ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে।
কারাগার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নজরদারি ও নিরাপত্তার মূল সমস্যা হলো জনবল ও প্রযুক্তিগত সংকট। পাশাপাশি কারা সদস্যদের দীর্ঘদিনের অপরাধমূলক চর্চা থেকে বের করা কঠিন হচ্ছে। এ কারণে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের প্রক্রিয়া সহজ হচ্ছে না।
এ অবস্থায় কারাগারকে নিরাপদ করতে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা। সেখানে কারাগারের ভেতরে মুঠোফোন জ্যামারের কার্যকরী ব্যবহার, আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কারাগারে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে যথাযথ পর্যবেক্ষণ, স্ক্যানার প্রযুক্তি উন্নত করা এবং তল্লাশি জোরদারের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
কয়েদিদের কাছে ফোন সেট ও সিম সরবরাহকারী অসৎ কারারক্ষী ও কর্মচারীদের শনাক্ত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এসবি যেসব মুঠোফোন নম্বর শনাক্ত করেছে, সেগুলোর ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগারের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের ভেটিং করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কারা মহাপরিদর্শক সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, এসবির প্রতিবেদনটি নজরে এসেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান চালিয়ে কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ব্যাপকভিত্তিক অভিযান চালিয়ে মুঠোফোন ব্যবহার কমিয়ে আনা গেলেও তা শূন্য অবস্থায় নেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, জনবল, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা—সব জায়গাতেই ঘাটতি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, অতীতে নিয়োগপ্রক্রিয়াতেও অনেক গলদ ছিল, যার কারণে অনুপযুক্ত লোকজনও এখানে ঢুকে গেছে। এখন তাদের সংশোধন করে সঠিক পথে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে।