অনলাইন আলোচনা

স্তন ক্যানসার নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙছে, বাড়ছে সচেতনতা

‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয়
ছবি: প্রথম আলো

‘বাংলাদেশে স্তন ক্যানসার সম্পর্কে যে ভয়, কুসংস্কার ও ভুল ধারণা ছিল, তা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। মানুষ এখন বুঝতে শুরু করেছে—ক্যানসার মানেই মৃত্যু নয়।’

এসকেএফ অনকোলজির আয়োজনে ‘বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় কথাগুলো বলেন ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন।

অক্টোবর মাস স্তন ক্যানসার সচেতনতার মাস। সবার মধ্যে স্তন ক্যানসারবিষয়ক সচেতনতা তৈরিতে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) অনলাইনে আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে অতিথি হিসেবে ছিলেন আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন। উপস্থাপনায় ছিলেন নাসিহা তাহসিন।

এ পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘স্তন ক্যানসার বার্তা’। বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, ডায়াগনসিস, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা, সচেতনতা, প্রতিরোধব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে পরামর্শ দেন ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন। পর্বটি সরাসরি প্রচারিত হয় প্রথম আলো ডটকম এবং প্রথম আলো, এসকেএফ অনকোলজি ও এসকেএফের ফেসবুক পেজে।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক রোগী আসেন বুকে ব্যথার কারণে, কিন্তু তাদের ক্যানসার নয়। আবার যাঁদের আসলেই ক্যানসার, তাদের বেশির ভাগেরই কোনো ব্যথা থাকে না। মানুষের মধ্যে ক্যানসার নিয়ে ভুল ধারণা আছে—বুকে ব্যথা মানেই ক্যানসার, ব্যথা না থাকলে কিছু হয়নি। আসলে অনেক সময় ব্যথা থাকলে তা ক্যানসার না–ও হতে পারে। তাই ব্যথার ওপর নির্ভর না করে পরীক্ষা করানো জরুরি।’

স্তন ক্যানসার কতটা জিনগত এবং পারিবারিক ইতিহাস থাকলে কী করণীয়? উপস্থাপকের এমন প্রশ্নের উত্তরে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘স্তন ক্যানসার সব সময় বংশগত নয়। মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে পারিবারিক ইতিহাস ভূমিকা রাখে। বাকি ৮৫ শতাংশ ক্যানসারের পেছনে মূল কারণ আমাদের পরিবর্তিত জীবনযাপন ও জীবনধারা।’

স্তন ক্যানসার কি কখনো উপসর্গবিহীন হতে পারে? বা আপনার কাছে কি কখনো এমন কোনো রোগী এসেছেন, যাঁর কোনো উপসর্গ ছিল না? জানতে চাওয়া হলে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘অনেক রোগীর ক্ষেত্রে কোনো ব্যথা, রক্তপাত বা ওজন কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যায় না; শুধু স্তনে একটি চাকা অনুভূত হয়। এ কারণেই অনেকেই চিকিৎসা নিতে দেরি করেন। বেশির ভাগ সময় স্তন ক্যানসার একদমই উপসর্গহীন থাকে। তাই ব্যথা না থাকলেও যদি স্তনে কোনো চাকা বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন অনুভব করেন, তাহলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।’

অনেকে কনট্রাসেপটিভ পিল বা হরমোনাল থেরাপি ব্যবহার করেন। এ ধরনের ওষুধ সেবনে কি স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে কিনা? উপস্থাপক জানতে চাইলে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন জানান, ‘দীর্ঘদিন ধরে হরমোন–জাতীয় ওষুধ গ্রহণ স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল বা পোস্টমেনোপজাল নারীদের জন্য হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপিতে থাকা ইস্ট্রোজেন হরমোনই মূলত স্তন ক্যানসারের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান। তবে স্বল্প মেয়াদে অর্থাৎ এক-দুই মাস বা কয়েক দিন এসব ওষুধ সেবনে ক্যানসারের ঝুঁকি তেমন বাড়ে না।’

বাংলাদেশে স্তন ক্যানসারের বর্তমান পরিস্থিতি, রোগনির্ণয়, ডায়াগনসিস ও চিকিৎসা-সুবিধা বিষয়ে পরামর্শ দেন ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন

কোন বয়স থেকে স্তন ক্যানসারের স্ক্রিনিং শুরু করা উচিত? এ প্রসঙ্গে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘৪০ বছর বয়সের পর থেকেই নারীদের নিয়মিত স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং শুরু করা উচিত। যাঁদের পরিবারে কারও স্তন ক্যানসারের ইতিহাস আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং শুরু করতে হবে আরও ১০ বছর আগে থেকে।’

নারীদের জন্য আলট্রাসনোগ্রাম আর বয়স্কদের জন্য ম্যামোগ্রামের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন জানান, ম্যামোগ্রাম হলো একধরনের এক্স-রে পরীক্ষা, যা মূলত ৪০ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের জন্য কার্যকর। কারণ, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তনের টিস্যুতে ফ্যাটি পরিবর্তন হয়, তখন এক্স-রে রেডিয়েশন সহজে প্রবেশ করে এবং স্পষ্টভাবে দেখা যায়। কিন্তু ৪০ বছরের নিচে নারীদের ক্ষেত্রে স্তনের টিস্যু ঘন থাকে, ফলে ম্যামোগ্রামে সমস্যা ধরা পড়া কঠিন হয়। এ বয়সে আলট্রাসাউন্ড বা এমআরআই বেশি কার্যকর; কারণ, এগুলো ঘন টিস্যুর মধ্যেও পরিবর্তন, সিস্ট বা টিউমার সহজে শনাক্ত করতে পারে।

স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপির সময় চুল পড়া, শারীরিক ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া এবং সাম্প্রতিক নতুন থেরাপি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘কেমোথেরাপির সময় চুল পড়া একটি সাধারণ ও সাময়িক প্রক্রিয়া। কিছু ওষুধের কারণে চুল পড়ে, তবে রোগীদের প্রথমেই আশ্বস্ত করা জরুরি—রোগটি নিরাময়যোগ্য এবং কেমোথেরাপি শেষ হলে চুল আবার গজায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্যানসার-চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রোগীরা যেন প্রতিদিন অন্তত ২০ থেকে ৩০ মিনিট সমান্তরাল রাস্তায় হাঁটেন এবং হাতের ব্যায়াম করেন।’

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে নরসিংদী জেলা থেকে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত শামীমা আক্তার তাঁর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমার বুকে একটা টিউমার ধরা পড়ে। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে যখন জানতে পারলাম এটা ব্রেস্ট ক্যানসার, তখন পুরো পরিবার হতাশ হয়ে পড়ে। কী করব, কোথায় যাব—বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’

শামীমা আক্তার বলেন, ‘পরে খোঁজ পেয়ে রাজধানীর আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে যাই। ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে চিকিৎসা শুরু করি। ম্যাডাম আমার রিপোর্ট দেখে অপারেশনের পরামর্শ দেন। আমি অপারেশন করি, তারপর আটটা কেমো আর ১৫টি রেডিওথেরাপি নিই। চিকিৎসার সময় চুল পড়া, শারীরিক দুর্বলতা আর মানসিক ক্লান্তি—সবকিছু মিলিয়ে প্রথম দিকে কেমো নিতে খুব কষ্ট হতো। ধীরে ধীরে নিয়ম মেনে চিকিৎসা শেষ করে এখন আমি অনেকটাই সুস্থ।’

অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে স্তন ক্যানসার চিকিৎসার অগ্রগতির বিষয়ে ডা. নওশিন তাসলিমা হোসেন বলেন, ‘এখন আর চিকিৎসা শুধু সার্জারি, কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপিতেই সীমাবদ্ধ নয়। যোগ হয়েছে টার্গেটেড থেরাপি ও ইমিউনোথেরাপি, যা রোগীর হরমোন রিসেপ্টর ও জেনেটিক প্রোফাইল অনুযায়ী কাজ করে।’