আরাফাত ও হিরো আলমের ভোটে দুই চিত্র

হিরো আলম ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত
 হিরো আলম ও মোহাম্মদ আলী আরাফাত

ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এই কম ভোটের মধ্যেও এলাকাভিত্তিক ভোট পড়ার হারে আছে বড় ধরনের পার্থক্য। আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলমের পাওয়া ভোটের ক্ষেত্রেও এলাকাভিত্তিক এই ফারাক দেখা গেছে।

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, বনানী, বারিধারা, মহাখালী ও মিরপুরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ আসন। এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত এই আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ে ৩৭ হাজার ৪২০টি। সে হিসাবে ভোট পড়ার হার ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। প্রদত্ত ভোটের ৭৭ শতাংশ পেয়ে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম পান ১৫ শতাংশ ভোট। বাকি ভোট পেয়েছেন অন্য প্রার্থীরা।

এই আসনে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ১২৪টি। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১২৪টির মধ্যে ২৩টি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। এই কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ১৪টি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়, ৫টি গুলশানে, ২টি বনানীতে, ১টি মাটিকাটায় এবং আরেকটি কেন্দ্র বারিধারায়। এগুলো (মাটিকাটা এলাকা বাদে) রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত। কম ভোট পড়া কেন্দ্রগুলোর মধ্যে নারী ভোটারদের কেন্দ্রই বেশি। এই ২৩টি ভোটকেন্দ্রে আরাফাত পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৬৫ শতাংশ। আর হিরো আলম পেয়েছেন প্রায় ২৪ শতাংশ। এই এলাকায় হিরো আলম অন্য এলাকার তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছেন।

দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। মানুষ মনে করছে, তাদের ভোট দিয়ে লাভ নেই। কে জয়ী হবে, তা জানা। এ কারণে ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হয়েছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন

তবে ঢাকা-১৭ আসনের ৩০টি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ১৫ শতাংশের ওপরে, এর মধ্যে ১১টিতে ভোট পড়ে ২০ শতাংশের বেশি। এই ভোটকেন্দ্রগুলো মিরপুর, মহাখালী, মাটিকাটা, কড়াইল, বালুঘাট, বাইগারটেক, কালাচাঁদপুর—এসব এলাকায় অবস্থিত। এসব এলাকায় বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের বসবাস। এমনিতে দুটি ভোটকেন্দ্র বাদে সব কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন। এই কেন্দ্রগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তুলনামূলক বেশি ভোট পেয়েছেন। অন্যদিকে অভিজাত এলাকার তুলনায় এখানে ভোট কম পেয়েছেন হিরো আলম। এই ৩০টি ভোটকেন্দ্রে আরাফাত পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৭৯ শতাংশ। আর হিরো আলম পান ১৩ শতাংশ ভোট।

ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ছিলেন ২ হাজার ৪২৯ জন। এর মধ্যে ভোট দেন মাত্র ২৪ জন। ভোট পড়ার হার শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ। এই ২৪ ভোটের মধ্যে আরাফাত পান ১১ ভোট আর হিরো আলম পান ৮ ভোট।

এই নির্বাচনের পর একটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ একটি বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে একটি নির্দিষ্ট এলাকার কারা কারা ওই নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলিট’ ভোটারদের এলাকায় ক্ষমতাসীন দল প্রভাব বিস্তার করেনি বা করতে পারেনি। অন্য এলাকায় কম ভোট পাওয়ার কারণ, ওই এলাকাগুলোতে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া বস্তি এলাকায় জাল ভোটের ঘটনা বেশি ঘটেছে বলেও তিনি দাবি করেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

৫ শতাংশের কম ভোট

এই উপনির্বাচনে ৫ শতাংশের কম ভোট পড়েছে যে ভোটকেন্দ্রগুলোতে, সেগুলো হলো আইডিয়াল পাবলিক স্কুল, নিচতলা (মাটিকাটা, মহিলা ভোটার), গুলশানের মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ (একাডেমিক ভবন, দ্বিতীয় তলা মহিলা ভোটার কেন্দ্র), মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ (বালক ভবন, দ্বিতীয় তলা, মহিলা ভোটার কেন্দ্র-২), গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে মহিলা ভোটারদের দুটি কেন্দ্র, বনানী বিদ্যানিকেতনের মহিলা ভোটার কেন্দ্র-১ ও ২, নিকেতন হাউজিং সোসাইটি কার্যালয় জহুরুল ইসলাম মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স (মহিলা ভোটার), আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের চারটি ভোটকেন্দ্র (কেন্দ্র নম্বর ১, ২, ৩ ও ৪), মহাখালী ডিওএইচএসে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (মহিলা ভোটার), বিএএফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলা মহিলা ভোটার কেন্দ্র, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজে চারটি কেন্দ্র (পুরুষ ভোটার-২, মহিলা ভোটার, পুরুষ ও মহিলা ভোটার কেন্দ্র ১ ও ২), বারিধারা স্কলার্স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (মহিলা ভোটার), ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলের তিনটি ভোটকেন্দ্র (১, ২ ও ৩) এবং তেজগাঁওয়ে বিএএফ শাহীন কলেজ কেন্দ্র। এই ভোটকেন্দ্রগুলোতে মোট ভোটার ছিলেন ৬০ হাজার ২৮ জন। কিন্তু ভোট দিয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৯৭৭ জন।

১ শতাংশের কম ভোট দুই কেন্দ্রে

এই উপনির্বাচনে দুটি ভোটকেন্দ্রে ভোট পড়ার হার ১ শতাংশের কম। এর মধ্যে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ (মহিলা ভোটার, কেন্দ্র-৪) কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিলেন ১ হাজার ৯৯৮ জন। ভোট দিয়েছেন মাত্র ১৯ জন। এখানে ভোট পড়ার হার শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ। এই ১৯ ভোটের মধ্যে আরাফাত পেয়েছেন ১২ ভোট আর হিরো আলম পান ৪ ভোট।

১ শতাংশের কম ভোট পড়া আরেকটি ভোটকেন্দ্রও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। সেটি হলো শহীদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল (পুরুষ ও মহিলা ভোটার) কেন্দ্র-২। এই ভোটকেন্দ্রে মোট ভোটার ছিলেন ২ হাজার ৪২৯ জন। এর মধ্যে ভোট দেন মাত্র ২৪ জন। ভোট পড়ার হার শূন্য দশমিক ৯৯ শতাংশ। এই ২৪ ভোটের মধ্যে আরাফাত পান ১১ ভোট আর হিরো আলম পান ৮ ভোট।

এক কেন্দ্রে জয় হিরো আলমের

১২৪টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ১২২টিতে বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তবে একটি কেন্দ্রে তিনি হিরো আলমের চেয়ে কম ভোট পান। আরেকটি কেন্দ্রে দুজনেই সমান ভোট পান। যে কেন্দ্রটিতে হিরো আলম জয়ী হন, সেটি হলো মহাখালী ডিওএইচএসে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও কলেজ (পুরুষ ভোটার) কেন্দ্র-১। এই কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ২২৫টি। এর মধ্যে হিরো আলম পান ১১০ ভোট। আর আরাফাত পান ৭৯ ভোট।

এ ছাড়া ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় শহীদ বীর বিক্রম রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল (পুরুষ ও মহিলা ভোটার) কেন্দ্র-১-এ আরাফাত ও হিরো আলম সমান ভোট পান। এখানে মোট ৬০ ভোট পড়ে। এর মধ্যে এই দুই প্রার্থী সমান ২৫ ভোট করে পান।

অন্যদিকে ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৩০টি কেন্দ্রে। এগুলোর বেশির ভাগই পুরুষ ভোটারের কেন্দ্র।

তবে সামগ্রিকভাবেই নারী ভোটারের বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোটের হার কম হলেও যে কেন্দ্রটিতে ভোট পড়ার হার সবচেয়ে বেশি ছিল, সেটি ছিল নারী ভোটারের কেন্দ্র। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ার হার সবচেয়ে বেশি ছিল পশ্চিম ভাষানটেকে অবস্থিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা উচ্চবিদ্যালয়ের মহিলা ভোটার-২ কেন্দ্রে। এখানে ভোট পড়ার হার ছিল ২৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে এলাকাভিত্তিক ভোটের হার ও দুই প্রার্থীর ভোট পাওয়ার যে তারতম্য, তাতে ইসি একটি নতুন ধারা পেয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর বিষয়ে নির্বাচন কমিশন খতিয়ে দেখতে পারে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। মানুষ মনে করছে, তাদের ভোট দিয়ে লাভ নেই। কে জয়ী হবে, তা জানা। এ কারণে ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হয়েছে।