
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পাস করার পর জেসমিনের বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিল, সে যেন বাড়ির কাজে মন দেয়।
কখনো আর্থিক অনটনে জেসমিন খাতুনের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, আবার কখনো বিয়ের প্রস্তাবে জেসমিনের স্বপ্ন ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু কিছুতেই দমে যায়নি সে। ক্লাসের বাইরে মাঠের খেলাধুলায় দ্যুতি ছড়িয়েছে জেসমিন। ৫০তম জাতীয় শীতকালীন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অ্যাথলেটিকসে চাকতি নিক্ষেপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জেসমিন খাতুন।
জেসমিনের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের কামার হাল্যা গ্রামে। তার বাবা মো. জমির উদ্দিন পেশায় দিনমজুর। আর মা শাহাজাদী বেগম গৃহিণী। জেসমিনদের ভিটের জমিটুকু ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই। বাবা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে যা আয় করেন, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে তাদের।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পাস করার পর জেসমিনের বাবা–মায়ের ইচ্ছা ছিল, সে যেন বাড়ির কাজে মন দেয়। কিন্তু জেসমিনের ইচ্ছা ছিল পড়া চালিয়ে যাওয়ার। অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়ে ২০১৮ সালে জেসমিন ঘোগাদহ মালেকা খাতুন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে স্কুল। সকালে হেঁটেই যেতে হয়। তবে সেখানে ভর্তির পর জেসমিনের স্বপ্নের জানালা খুলে যায়।
সেখানে সহপাঠিরা ক্লাস শুরু হওয়ার আগে আর টিফিনের সময় খেলাধুলা করে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বন্ধুদের খেলা দেখত জেসমিন। সাহস করে কখনো মাঠে নামেনি। একদিন ক্রিকেট খেলায় খেলোয়াড় কম পড়লে বন্ধুরা জোর করে জেসমিনকে মাঠে নামিয়ে দেয়। পরে জেসমিনের খেলা দেখে সবাই প্রশংসা করে। এর পর থেকে স্কুলের ক্রিকেট দলের নিয়মিত সদস্য হয়ে যায় সে।
জেসমিন বলে, ‘প্রধান শিক্ষক আবদুল মালেক একদিন আমাকে প্রশ্ন করেন, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? আমি সময় না নিয়ে বলি, খেলোয়াড়। এরপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মালেক স্যারসহ স্কুলের সবাই উৎসাহ দিয়েছেন। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের আর্থিক সহায়তায় আমি এতদূর আসতে পেরেছি।’
জেসমিন এখন দশম শ্রেণিতে পড়ছে। অথচ এক বছর আগেই জেসমিনের বাবা–মা তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। জেসমিন জানায়, প্রায়ই পরিবারের কাছে তার বিয়ের প্রস্তাব আসত। প্রতিবার সে আপত্তি জানিয়ে বিয়ে থামিয়ে রেখেছিল। তবে গতবার তার বাবা–মা নাছোড়বান্দা ছিলেন। উপায় না পেয়ে বিষয়টি শিক্ষকদের জানায় জেসমিন। পরে শিক্ষকেরা জেসমিনের বাড়িতে এসে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন।
জেসমিন বলে, ‘কুড়িগ্রাম স্টেডিয়ামে সোহেল রানা ও আবদুল মতিন স্যার আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁদের প্রশিক্ষণে অনেক উন্নতি হয়েছে। আর স্কুলের শরীরচর্চার শিক্ষক রুনি ম্যাডাম সব সময় বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। পুরোপুরি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর গত বছর চাকতি নিক্ষেপসহ ক্রিকেটে জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আর এ বছর তো সবার দোয়ায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম।’
মা শাহাজাদী বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। মেয়েকে ঠিকমতো পড়ার খরচই দিতে পারি না। মেয়ে বড় হচ্ছে। মানুষ নানা কথা বলে, অনেক সময় খারাপ লাগে। তাই বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু মেয়ে বিয়ে করবে না। এখন আমরাও জোর করি বিয়া দেব না।’
প্রধান শিক্ষক আবদুল মালেক বলেন, জেসমিন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তবে তাকে উৎসাহ দিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সব ধরনের সহযোগিতা করে। পড়াশোনা আর খেলাধুলা—দুটিতেই জেসমিনের আগ্রহ আছে। সে তার বাল্যবিবাহ রোধ করে ইউনিয়নের মেয়েদের কাছে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।