পথে পথে

তবু প্রাইভেট, তবু কোচিং

পথে পথে
পথে পথে

উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার। এমন একটি সরকারি কলেজের বিশাল প্রাঙ্গণ ভরদুপুরে এমন নির্জন ও নীরব কেন? শনিবার দুপুর ১২টায় ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে ঢুকে এই প্রশ্নটা মনে জাগে। মূল ভবনের বারান্দার গ্রিলে একটা ব্যানার ঝুলতে দেখে উত্তর পাওয়া গেল: সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ঘোষিত নতুন বেতনকাঠামোর প্রতিবাদে শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলছে। তবু এগিয়ে যাই। বিজ্ঞান ভবন-২ লেখা একটা ভবনের এক কক্ষের জানালা দিয়ে দেখতে পাই ভেতরের আলো-আঁধারিতে কয়েকজন তরুণের এক জটলা। জানালা দিয়ে তাঁদের কয়েকটি ছবি তুলে ঢুকে পড়ি সেই কক্ষের ভেতরে। তাঁদের গল্পগুজব থেমে যায়, তাঁরা কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকান।
পরিচয় দিয়ে জানতে চাই, শিক্ষকদের কর্মবিরতির সময় তাঁরা কলেজে এসেছেন কেন। তাঁরা বলেন, ঈদের ছুটি শুরু হচ্ছে, পরস্পরকে বিদায় ও আগাম ঈদ মোবারক জানাতে তাঁরা মিলিত হয়েছেন। কলেজের পড়াশোনা নিয়ে কথা শুরু করি: আপনারা নিয়মিত ক্লাস করেন? উদ্ভিদবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও রসায়নের অনার্স প্রথম বর্ষের এই ছাত্রদের মুখে লাজুক হাসি দেখা গেল। তারপর শোনা গেল এসব পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা: ‘নিয়মিত ক্লাসে আসা হয় না,’ ‘ক্লাসই ঠিকমতো হয় না,’ ‘টিচারেরা আসে না,’ ‘টিচারেরা আসে, আমরাই আসি না’ ইত্যাদি।
নিয়মিত ক্লাস না করলেও এই ছাত্রদের সবাই প্রাইভেট পড়েন নিয়মিতই। ‘অনার্সের ছাত্র হয়ে আপনারা প্রাইভেট পড়েন?’ বিস্ময়মাখা এই প্রশ্নের ধাক্কায় তাঁদের মুখগুলো কাচুমাচু হয়ে যায়। আরও প্রশ্ন করে জানতে পাই, তাঁরা তাঁদের কলেজের শিক্ষকদের কাছেই প্রাইভেট পড়েন। ওই কক্ষেরই এক কোণে একটা টেবিলে এক তরুণ বই-খাতায় বুঁদ হয়ে আছেন। তিনি গণিতে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র, এসেছেন পদার্থবিজ্ঞানের এক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে। কিছুক্ষণ পরে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন একই বিষয় ও বর্ষের আরও কয়েকজন ছাত্র। প্রাইভেট শিক্ষক আজ তাঁদের একটা পরীক্ষা নেবেন। তিনি এখনো এসে পৌঁছাননি।
কলাভবনের দোতলায় ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের কক্ষে ঢুকে মাত্র একজন সহযোগী অধ্যাপকের দেখা পাওয়া গেল। তিনি বললেন, কর্মবিরতির মধ্যেও তিনি এসেছেন। কারণ অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ইন-কোর্স পরীক্ষাটা নেবেন। তাঁর বিভাগের শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি, পড়াশোনায় আগ্রহ ও মান নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি হতাশ সুরে বললেন, কোনোটাই সন্তোষজনক নয়। দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনা, পাঠ্যবই ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের দুরবস্থা বর্ণনা করে তিনি বললেন, বিশেষত ইংরেজি শিক্ষার ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ। অনার্সের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়া প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বললেন, প্রাইভেট পড়েও শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছেন না, দেশের সামনে দুর্দিন।
কলেজটির অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া মণ্ডলের সঙ্গেও প্রধানত কথা হলো স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়া ও পড়ানো নিয়ে। বললাম, এই প্রবণতা কি এটাই প্রমাণ করে না যে শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা হয় না? তিনি বললেন, ‘এটা শুধু আমার কলেজের চিত্র নয়, সারা বাংলাদেশের সাধারণ চিত্র।’ তিনি অকপটে স্বীকার করলেন, এতে উচ্চশিক্ষা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের গড় মান নিয়েও তিনি বেশ হতাশা প্রকাশ করলেন।
ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজের ছোট্ট প্রাঙ্গণটিও শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে প্রায় নির্জন। অধ্যক্ষ চৌধুরী লায়লা আরজুমান্দ বানুসহ অধিকাংশ শিক্ষক অনুপস্থিত, ছাত্রীরাও নেই। তবে দুজন শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কয়েক মিনিটের আলাপে জানা গেল, প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থীর এই কলেজে শিক্ষকের পদ ৩৫টি, কর্মরত আছেন ২৩ জন। গত বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ, ৬০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাসের হার ছিল মাত্র ৫৮ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন মাত্র একজন। তবে একজন শিক্ষক বললেন, পরীক্ষার ফল নিয়ে তিনি চিন্তিত নন, তিনি চিন্তিত সারা দেশের শিক্ষার সার্বিক মানের অবনতির ব্যাপারে। এ সময় তিন ছাত্রীকে একটি ভবন থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তাঁরা অনার্সে পড়েন, এক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে এসেছেন। যে শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলছিলাম, এ প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বললেন, তার মানে লেখাপড়া কিছুই হচ্ছে না। তিনি এটাও যোগ করলেন যে এটা শুধু এই কলেজের নয়, সারা দেশের বাস্তবতা।
মাধ্যমিক শিক্ষকদের কর্মবিরতি নেই, সুতরাং ঠাকুরগাঁও সরকারি বিদ্যালয়ের বিশাল প্রাঙ্গণটি শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে মুখরিত। মাঠের এক কোণে ক্রিকেট খেলছে দশম শ্রেণির ছাত্ররা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা সবাই নিয়মিত ক্লাসে আসে। আবার একই সঙ্গে প্রত্যেকেই চার-পাঁচটা করে বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে কিংবা কোচিং করে।
‘প্রাইভেট-কোচিং কেন? ক্লাসে কি লেখাপড়া হয় না?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলে, ক্লাসে লেখাপড়া হলেও প্রাইভেট পড়তে হয়, কোচিং করতে হয়। কারণ পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হবে। দশম শ্রেণির ফার্স্ট বয়কে খুঁজে বের করে জানতে চাইলাম, সে-ও প্রাইভেট পড়ে কি না। তার উত্তর: হ্যাঁ, চারটা বিষয়ে।
প্রধান শিক্ষক মো. আখতারুজ্জামান জানালেন, দুই শিফটে এ স্কুলে মোট ১ হাজার ৮৬৮ জন ছেলে পড়ে। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ৯৫ শতাংশ। গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ১০০ শতাংশ। ঠাকুরগাঁও জেলায় ফলাফলের দিক থেকে দ্বিতীয় সেরা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এটি।
সেরা হলো ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, যেখানে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দুই শিফটে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৮৮৫। টিফিনের বিরতিতে অধ্যক্ষ বাসায় গেছেন, একজন সহকারী শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ১৫৩ জন। স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান সবই এখানে ভালো, তবু এখানকার শিক্ষার্থীরাও চার-পাঁচটি করে বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে, কোচিং সেন্টারে যায়।
ঠাকুরগাঁওয়ের শিক্ষাচিত্র সম্ভবত সারা দেশের সাধারণ শিক্ষাচিত্র থেকে আলাদা নয়। প্রাইভেট আর কোচিং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সমান্তরাল এক ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে উঠেছে, যা ক্ষতিকর বলে স্বয়ং শিক্ষকেরাও স্বীকার করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্ষতিকর সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা ভাঙা যাচ্ছে না কেন?