পুকুর ‘গায়েব’, গড়ে উঠেছে বিপণিবিতান

* ২০১২ সালের ডিসেম্বরে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা নেওয়া হয় এই পুকুর।
*ইজারাদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ১০ জনকে আসামি করে দুদকের অভিযোগপত্র।

পুকুর মাছ চাষের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা নেন মীর মোয়াজ্জেম হোসেন। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী মাছ চাষ করেননি, পুকুর ভরাট করে বিপণিবিতান নির্মাণ করেন তিনি। ৩ অক্টোবর
ছবি: জুয়েল শীল

আট বছর আগে রেলওয়ের ২৮ শতকের একটি পুকুর অস্থায়ী ইজারা দেওয়া হয় মাছ চাষের জন্য। কিন্তু পুকুর ভরাট করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিপণিবিতান, গাড়ির গ্যারেজ ও সেমিপাকা ঘর। মাছ চাষের বদলে এসব স্থাপনা ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন ইজারাদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী।

চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর-অক্সিজেন সড়কসংলগ্ন বিবিরহাটের ৫০০ গজ পশ্চিমে নাজিরহাট রেললাইনসংলগ্ন জায়গা নিয়ে এই কাণ্ড। রেলওয়ের নথি অনুযায়ী, এটি পুকুর-জলাশয় শ্রেণির। এ নিয়ে নোটিশ, মামলা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে মাছ চাষ তো দূরের কথা, পুকুরের অস্তিত্ব নেই। পুরো এলাকায় সীমানা দেয়াল দেওয়া। সামনের অংশে গড়ে তোলা হয়েছে ‘সলিমউল্লাহ শাহ মার্কেট’ নামের বিপণিবিতান। এতে ওষুধ, মুদি, টেইলার্সসহ ১৫টি দোকান রয়েছে, সঙ্গে একটি গ্যারেজ। ভরাট করা ভেতরের বাকি জায়গার কিছু অংশ খালি ও কিছু অংশে সেমিপাকা ঘর।

ভাড়াটেরা জানান, প্রতিটি দোকান বাবদ নেওয়া হয়েছে দুই থেকে তিন লাখ টাকা করে অগ্রিম। এ ছাড়া মাসে দুই হাজার টাকা করে ভাড়া নেন, গ্যারেজভাড়া পাঁচ হাজার। সেই হিসাবে প্রতিবছর ভাড়া বাবদ ইজারাদার পান ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। গত আট বছরে পেয়েছেন ৩৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর অগ্রিম পেয়েছেন প্রায় ৪০ লাখ টাকা। অথচ জায়গার মালিক রেলওয়ে।

দুদকের করা মামলার তদন্তেও এসব তথ্য উঠে আসে। এ জন্য দুদক রেলওয়ের ইজারাদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেনসহ ১০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে আদালতে। দুদকের আইনজীবী মাহমুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানির জন্য আগামী ১ নভেম্বর তারিখ ধার্য করেছেন মহানগর দায়রা জজ আদালত।

দুদক ও রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২৮ শতকের ( শূন্য দশমিক ২৮ একর) এ পুকুর মাছ চাষের জন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ১ কোটি ২০ লাখ ৭ হাজার ৭০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা নেন মীর মোয়াজ্জেম হোসেন। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী মাছ চাষ করেননি, পুকুর ভরাট করে বিপণিবিতান নির্মাণ করেন তিনি। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট তাঁকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নোটিশ দেয়। কিন্তু মীর মোয়াজ্জেমের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় ইজারা বাতিল করা হয় ২০১৪ সালের এপ্রিলে। পরে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করে। এ নোটিশের বিরুদ্ধে ইজারাদার উচ্চ আদালতে রিট করেন।

আট বছরেও রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগ নিজেদের জায়গা উদ্ধার করতে না পারার পেছনে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা উচিত। নইলে বছরের পর বছর বেহাত থাকবে রেলের সম্পত্তি।
আখতার কবির চৌধুরী, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক

২০১৯ সালের মে মাসে সেই রিট খারিজ হয় বলে জানায় দুদক। অথচ রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, রিট খারিজ হওয়ার বিষয়টি জানলেও কোনো কাগজপত্র তাঁরা পাননি।

দুদকের মামলা, অভিযোগপত্র

মাছ চাষের জন্য পুকুর ইজারা নিয়ে বিপণিবিতান ও গাড়ির গ্যারেজ করার অভিযোগে ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি দুদক চট্টগ্রামের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে ১১ জনের বিরুদ্ধে নগরের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। মামলায় ইজারাদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছাড়া বাকি ১০ জন বিপণিবিতানের ভাড়াটে।

শুরুতে মামলার তদন্ত করেন দুদক চট্টগ্রামের সাবেক সহকারী পরিচালক এইচ এম আখতারুজ্জামান। তিনি বদলি হলে উপসহকারী পরিচালক মো. শোয়েব তদন্ত করেন। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম।

প্রায় আড়াই বছর তদন্ত শেষে গত ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র জমা দেন। সেখানে ১০ জনকে আসামি করেন। তাঁরা হলেন মীর মোয়াজ্জেম হোসেন, ভাড়াটে আমির হোসেন, এনামুল হক, মিজানুর রহমান, শহীদুল ইসলাম, সুজিত দে, শামসুল আলম, রণজিৎ কুমার দাশ, মাহফুজুর রহমান ও মো. জাহেদ। তাঁরা সবাই জামিনে রয়েছেন। করোনায় মারা যাওয়া মো. সোলায়মানকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে ১২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়।

পুকুরে ময়লা ফেলার কারণে মাছ চাষ করা যায়নি। তাই ভরাট করে মার্কেট ও গ্যারেজ করা হয়েছে।
মীর মোয়াজ্জেম হোসেন, ইজারাদার

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে মাছ চাষ না করে পুকুর ভরাটের মাধ্যমে সেখানে স্থাপনা তৈরি করেন।

এখনো ইজারাদারের দখল

বর্তমানে মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে বিপণিবিতান দেখাশোনা করেন গুরা মিয়া নামের এক ব্যক্তি। তিনি তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে আছেন। এনামুল হক নামের এক দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন। সংসার চালানোর জন্য একটি দোকান ভাড়া নিয়ে টেইলার্স খোলেন। তাঁর মতো অন্য ভাড়াটেরা দাবি করেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য দোকান ভাড়া নিয়েছেন। দোকানের জায়গা বৈধ কি অবৈধ, তাঁরা তা জানেন না।

২৮ শতকের ( শূন্য দশমিক ২৮ একর) এ পুকুর মাছ চাষের জন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ১ কোটি ২০ লাখ ৭ হাজার ৭০০ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য ইজারা নেন মীর মোয়াজ্জেম হোসেন। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী মাছ চাষ করেননি, পুকুর ভরাট করে বিপণিবিতান নির্মাণ করেন তিনি।

মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ি কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে হলেও পরিবার নিয়ে তিনি থাকেন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে। মাছ চাষের জন্য ইজারা নিয়ে বিপণিবিতান নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, পুকুরে ময়লা ফেলার কারণে মাছ চাষ করা যায়নি। তাই ভরাট করে মার্কেট ও গ্যারেজ করা হয়েছে। পুকুরের জন্য ইজারা নিলেও বাণিজ্যিক ভবনের জন্য এখন রেলওয়েকে ভাড়া দিতে চান, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়েছে।

ইজারা বাতিল হলেও উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে জানান, উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে ইজারাদারের করা রিট খারিজের কাগজপত্র এখনো পাওয়া যায়নি। এটি পেলে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।

এভাবে এত বছর রেলওয়ের সম্পত্তি বেদখল থাকার সঙ্গে সংস্থার কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে জানান, আট বছরেও রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগ নিজেদের জায়গা উদ্ধার করতে না পারার পেছনে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা উচিত। নইলে বছরের পর বছর বেহাত থাকবে রেলের সম্পত্তি।