নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইল ইউনিয়নের কচুগাড়ি গ্রামের আবু সাঈদ তিন বছর ধরে ইরাকে থাকেন। তাঁর নামে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড (নম্বর-৪৭৮) রয়েছে। সেই কার্ডের বিপরীতে নিয়মিত চালও তোলা হয়েছে। অথচ সাঈদের পরিবার কিছুই জানে না।
উপজেলার চান্দাই ইউনিয়নের দিয়াড় গাড়ফা গ্রামের কেরামত আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন জানলেন, তাঁর নামে খাদ্যবান্ধব কার্ড (নম্বর ৩২৩) রয়েছে। কার্ডটি চোখের দেখাও দেখেননি। কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরে কার্ডের চাল সরবরাহ করেছেন সংশ্লিষ্ট ডিলার। ভান্ডারদহ গ্রামের মৃত ওসমান আলীর স্ত্রী আয়না বেগমের নামে দুটি কার্ড (৪৮৭ ও ৫৯২) রয়েছে। কিন্তু তিনি চাল পান না।
বড়াইগ্রাম উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে এভাবে নামে-বেনামে দুই শতাধিক কার্ড দিয়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল আত্মসাৎ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে সম্প্রতি এসবের লিখিত অভিযোগ করেছেন।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চাল আত্মসাতের এসব অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। তবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিতে গিয়ে এসব অনিয়ম জানাজানি হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্য সহায়তার তালিকা তৈরি করতে গিয়ে ভুক্তভোগীদের বঞ্চনার বিষয়টি উঠে আসছে।
তিন বছর ধরে জোনাইল ইউনিয়নে চারজন, চান্দাই ইউনিয়নে তিনজন ও নগর ইউনিয়নে তিনজন ডিলার রয়েছেন। জোনাইলে ১ হাজার ৭০৯, চান্দাইয়ে ১ হাজার ৫০৬ ও নগরে ২ হাজার ১৪ জন খাদ্যবান্ধব কার্ডের আওতায় আছেন। এসব তালিকায় হতদরিদ্র মানুষের নাম থাকার কথা থাকলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশে প্রবাসী, মৃত, অস্তিত্বহীন ও গোপন রাখা অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তির নাম স্থান পেয়েছে। কার্ডের মাধ্যমে তাঁদের নামে চাল তুলে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। খাদ্যনিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে নেওয়া তালিকা যাচাই করে ভুক্তভোগীরা তাঁদের বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন।
জোনাইল ইউনিয়নের চৌমুহন গ্রামের ভুট্টু প্রামাণিকের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির কার্ড (১৬৩৫) হয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। কিন্তু তিনি জানতেন না। সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হলে ডিলার গোপাল চন্দ্র সরকার ১৫ দিন আগে ডেকে নিয়ে এক বস্তা (৩০ কেজি) চালসহ কার্ডটি তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি মাত্র একবার চাল পেলেও তাঁর কার্ডে তিন বছর ধরেই চাল নেওয়ার টিপসই দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘আমি সই করতে পারি, এখানে টিপ দেব কেন? তা ছাড়া টিপও তো আমার না।’
একই গ্রামের ছামেরন বেগম (১৬৫২) দুবার চাল পেলেও ডিলারের লোক এসে কয়ে কমাস আগে কার্ডটি নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি। জালাল উদ্দিনের (১৬৮৯) স্ত্রী আম্বিয়া খাতুনও জানান যে, তাঁদের ডিলার চাল দেন না। ছয় মাস আগে চৌমুহন গ্রামের রাশেদা বেগম (১৬৫৮) মারা গেছেন, তবে তাঁর নামে নিয়মিত চাল তোলা হচ্ছে। চান্দাই ইউনিয়নের দিয়ার গাড়ফা গ্রামের কেরামত আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেনের (৩২৩) নামে নিয়মিত চাল তোলা হলেও কার্ডের তথ্য তাঁর জানা নেই।
ভান্ডারদহ গ্রামের হায়দার আলী (৫২৯) ও তাঁর স্ত্রী রহিমা খাতুনের (৫৫৯) নামে কার্ড রয়েছে। নিয়মিত চালও তোলা হচ্ছে। তবে বাবার নামে কার্ড থাকলেও মায়ের নামে কার্ড থাকার বিষয়ে জানেন না বলে জানান হায়দার আলীর ছেলে মো. রাসেল। একই গ্রামের জমেলা বেগমের (৫১৪) নামে কার্ড থাকলেও বিষয়টি জানেন না তিনি। একই গ্রামের সড়ক দুর্ঘটনায় আহত আয়ুব আলীর নামে রয়েছে দুটি কার্ড। যার নম্বর ৫৩৩ ও ৫৮১। তবে তাঁর কাছে একটি কার্ডও নেই। তিনি চালও পান না। ওই গ্রামের মৃত ওসমান আলীর স্ত্রী আয়না বেগমের (৪৮৭ ও ৫৯২) এবং চান্দাই গ্রামের হাবিবুর রহমানের (৭৯৬ ও ৭১৯) নামে জনপ্রতি দুটি করে কার্ডে চাল তোলা হচ্ছে। একই ভোটার আইডি নম্বর দিয়ে একজনের নামে দুটি করে কার্ড বহাল থাকলেও তা জানেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অনিয়মের বিষয়ে জোনাইল বাজারের ওএমএস ডিলার গোপাল চন্দ্র সরকার বলেন, চাল না দেওয়ার অভিযোগ সঠিক না। যে কার্ড নিয়ে এসেছে তাকে চাল দেওয়া হয়েছে। কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তা জানেন না। চান্দাই ইউনিয়নের গাড়ফা এলাকার ডিলার শফিকুল ইসলাম বলেন, একই ব্যক্তির নামে একাধিক কার্ড থাকার বিষয়টি জানা নেই। মৃত ব্যক্তিরা কীভাবে চাল নেন? জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
বড়াইগ্রামের ইউএনও আনোয়ার পারভেজ জানান, লিখিত অভিযোগ পেয়ে বিষয়টি তদন্তের জন্য উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক বিকাশ চন্দ্র মুঠোফোনে জানান, ইউএনও তাঁকে তদন্ত করতে দিয়েছেন। তাই এ পর্যায়ে কিছু বলা যাবে না।