
স্কুলের বালিকা ফুটবল দলের অধিনায়ক সে। তার নৈপুণ্যে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে স্কুলটি উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ভালো দৌড়বিদও। পড়াশোনায়ও বেশ ভালো। সব মিলিয়ে শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রী। আর ছাত্রছাত্রীদের কাছে প্রিয় ‘তমা আপু’।
তার পুরো নাম মোছা. তমা খাতুন। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তমার বিয়ে ঠিক করেছিল তার বাবা-মা। তবে বাবা-মাকে বুঝিয়ে নিজের বাল্যবিবাহ নিজেই ঠেকিয়েছে তমা। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের খোরশেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে সে।
ঘটনাটি প্রায় দেড় মাস আগের। বাবা সেকেন আলী স্কুল থেকে তমাকে ডেকে বাড়িতে নিয়ে যান। অন্যদিনের মতোই স্কুলের পোশাক বদলে বাইরে খেলতে যাবে, এমন সময় বাড়ির উঠানে অপরিচিত কয়েকজনকে দেখতে পায় সে। শুরু হয় বাড়ির লোকজনের ব্যস্ততা। তখন তাকে জানানো হলো, পাশের গ্রাম থেকে তার বিয়ের জন্য ঘটকসহ বরপক্ষের লোকজন তাকে দেখতে এসেছে।
বিয়ের কথা শুনতেই মন খারাপ হয়ে যায় তমার। একপর্যায়ে তমা নিজেই বাবা-মায়ের মুখোমুখি হয়। স্পষ্ট বলে দেয়, ‘আমি বিয়ে করব না, পড়াশোনা করব। আমাকে বিয়ে দিয়ে তুমরা মৃত্যুর মুখে ঠেইলি দিয়ো না।’ বাবা-মা পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। তমার জবাব, ‘আমার বিয়ের জন্যেই যে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হবি, সেই ট্যাকা তুমি (বাবা) আমাকে দিই দেও, সেটা দিয়ে আমি পড়ব। তুমার কাছ থেকে কোনো ট্যাকা নিবো না।’ তমার কথা যেন মনঃপূত হলো বাবা-মায়ের। একপর্যায়ে ঘটক ও বরপক্ষের লোকজন চলে গেল।
বাড়ি শিলাইদহের মাজগ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে তমার স্কুল। গতকাল শনিবার স্কুলে গিয়ে কথা হয় তমা, তার বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে। প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন জানালেন, ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলে তমা। ভালো দৌড়ায়। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে স্কুলের হয়ে প্রায় প্রতি ম্যাচেই গোল করেছে সে, যা উপজেলা পর্যায়ে তাঁদের স্কুলকে চ্যাম্পিয়ন করেছে।
তমার সাহসিকতায় খুশি তার বন্ধুরা। সন্ধ্যা নামে তার এক বন্ধু বলে, ‘তমা এখন আমাদের পাশে বসে ক্লাস করছে। খুবই ভালো লাগছে।’ স্কুল ছুটির পর এবড়োখেবড়ো মেঠোপথ আর খাল পার হয়ে তমার বাড়িতে গিয়ে কথা হলো তার পরিবারের সঙ্গে। তমার দাদা কুরবান আলী বললেন, ‘তমা নিজেই বিই (বিয়ে) ভাঙ্গি দিছে, এখুন বুঝতে পারইছি। ওর পথ ও নিজিই কইরি নিবি (করে নিবে)।’
বাবা সেকেন আলী বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। একা একা মাঠের মধ্যে দিয়ে স্কুলে যায়। এই জন্যেই বিয়ে দিতে চাইছিলাম। তবে মেয়ে আমার চোখ খুলে দিয়েছে। ও যত দূর পড়তে চাই তত দূর পড়াব।’
বড় হয়ে চিকিৎসক নয়তো পুলিশ হতে চায় তমা। চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের সেবা করা কিংবা দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক রেখে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে।