
যিনি করোনা বিষয়ে শপিংমলে সচেতনতা চালাচ্ছেন, তাঁর মুখের মাস্ক ঠিক নেই। আবার যে তরুণী ফুল কিনছেন, তাঁরও একই অবস্থা। মাস্ক মুখেই তুলছেন না বিক্রেতারা। অনেক ক্রেতারও একই অবস্থা। মাস্ক ঝুলে থাকছে বুকে, থুতনিতে। রাজশাহীতে ঈদের পর থেকে হু হু করে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। নমুনা পরীক্ষায় রাজশাহীতে করোনা শনাক্তের হার ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। হাসপাতালে রোগীর তীব্র চাপ, বাড়ছে মৃত্যুও। তবু মানুষের মধ্যে বাড়েনি সচেতনতা।
করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় রাজশাহী জেলাকে বিশেষ বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে। নতুন বিধিনিষেধ অনুযায়ী, সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত জরুরি পরিষেবা ও আম–সংক্রান্ত কার্যক্রম বাদে সবকিছু বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশ তৎপর দেখা গেছে। তবে দিনের পরিস্থিতি করোনার সংক্রমণের জন্য ভয়াবহ।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে হ্যান্ডমাইক নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর ভূমিকা দেখা যায়। তাঁরা হ্যান্ডমাইকে মানুষকে দ্রুত বাসাবাড়িতে চলে যেতে বলছেন। ব্যবসায়ীদের দ্রুত দোকানপাট বন্ধ করতে বলছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একই দৃশ্য দেখা যায় রাজশাহী নগরে। সারা দেশে চলমান বিধিনিষেধ থাকলেও দিনভর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ছে না। ফলে মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কম।
আজ শনিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী নগরে প্রতিদিনের মতো লোকজন বাড়তে থাকে। নগরের সাহেববাজার এলাকায় অটোরিকশার জটও দেখা যায়। নগরের সব ধরনের দোকানপাট খোলা রয়েছে। অধিকাংশই মানছেন না স্বাস্থ্যবিধি। অনেক ক্রেতা-বিক্রেতাকেও মাস্ক ছাড়া দেখা গেছে।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজশাহী নগরের সাহেববাজার এলাকায় সবচেয়ে বড় শপিংমল আরডিএ মার্কেট এলাকায় ঢুকতেই শোনা যাচ্ছে, ‘করোনা সচেতনায় মাস্ক পরুন, নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান। সঠিকভাবে মাস্ক পরুন।’ যে লোকটি হ্যান্ডমাইক নিয়ে এই ঘোষণা দিচ্ছিলেন, তাঁর নিজের মাস্কই ঠিক থাকছে না। তিনি নিজের পরিচয়ও দিলেন না। তবে তিনি কমিউনিটি পুলিশের সদস্য বলে পাশের এক ব্যক্তি জানালেন। আরডিএ মার্কেট ও তার আশপাশের দোকানগুলোতে পোশাক বিক্রি হতে দেখা যায়। সেখানে দোকানিদের মুখে মাস্ক নেই। তবে সেখানে ক্রেতাদের অধিকাংশের মুখে মাস্ক দেখা গেছে।
সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে দুই তরুণী ফুল কিনছিলেন। তাঁর মাস্কটি থুতনিতে ঝুলছিল। তাঁর সঙ্গে থাকা তরুণীরও একই অবস্থা। ওই এলাকায় ছবি তোলা দেখে মাস্ক পরলেন এক নারী। একই এলাকায় মাস্ক ছাড়াই ছারপোকা, ইঁদুর মারার ওষুধ ডেকে ডেকে বিক্রি করছিলেন এক বিক্রেতা। নগরের মণি চত্বর এলাকায় রিকশায় যাচ্ছিলেন তিন তরুণ। তাঁদের একজনের মাস্ক নেই, একজনের বুকে ঝুলানো, আরেকজনের থুতনিতে। চালকেরও থুতনিতে।
স্বাস্থ্যবিধি অমান্যের সবচেয়ে আশঙ্কাজনক চিত্রের দেখা মিলল নগরের মাস্টারপাড়া কাঁচাবাজার এলাকায়। এ বাজারের খুব কম বিক্রেতার মুখেই মাস্ক দেখা গেছে। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ছবি তোলার সময় এক বিক্রেতা তো লজ্জায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দিলেন। মাস্ক না পরার কারণ হিসেবে জিজ্ঞেস করতেই তাঁরা বলে উঠছেন, গরমের কারণে তাঁরা মাস্কটি খুলে রেখেছেন। ওই এলাকার কাঁচামাল ব্যবসায়ী আবদুস সাত্তারের মুখে মাস্ক ছিল না। তাঁর কাছে সবজি কিনতে আসা ক্রেতারও মাস্ক ছিল না। আবদুস সাত্তার বলেন, সকালে ভ্যানে করে আসার সময় তাঁর মাস্কটি কোথাও হারিয়ে গেছে। পরে আর কেনা হয়নি। মাস্ক পরা ছাড়া কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গেও কথা হয়, তাঁরাও অনেকে ভুলে মাস্ক পরেননি বলে জানালেন।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাতে রাজশাহী মেডিকেলের ২ ল্যাবে মোট ২৬৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১৩১ জনের পজিটিভ এসেছে। নমুনা পরীক্ষার হিসাবে শনাক্তের হার ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ। রাজশাহীতে এর আগে সর্বোচ্চ এক দিনে শনাক্তের হার ছিল গত ২৮ মে ৪৬ দশমিক শূন্য ২। রাজশাহীতে পিসিআর ল্যাবের পাশাপাশি ১০টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে আরও ২ জন। রাজশাহী জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৩৩ জন। এই জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৩ জন। মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৬১। এর মধ্যে নগরেই রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ৭৪২ জন। মোট মারা গেছেন ৯৩ জন। নগরে মারা গেছেন ৫৯ জন।
রাজশাহী জেলায় দৈনিক সংক্রমণ ১০০–এর নিচে নামছেই না। এই জেলার দৈনিক মোট শনাক্ত রোগীর বড় অংশই রাজশাহী নগরের। করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজশাহীতে কম বয়সীরাও মারা যাচ্ছেন। টিকা কার্যক্রম শুরু হতেও দেরি হবে। এ অবস্থায় মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মানাই একমাত্র উপায় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন মো. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, বর্তমানে মাস্কই টিকা। মাস্ক পরা ছাড়া আর স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া করোনা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। অনেকে দুবার টিকা নেওয়ার পর আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তাঁরা করোনার এই পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন। মাস্ক না পরলে, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে খুব শিগগির আরও কঠোর বিধিনিষেধ আসবে বলে জানালেন তিনি।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, তাঁরা সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত বিশেষ বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করছেন। এ সময়ে কাউকেই বাইরে থাকতে দিচ্ছেন না। তবে দিনের বেলায় তাঁরা স্বাভাবিকভাবে মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছেন। কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত এলে তাঁরা আরও বেশি কড়াকড়ি করবেন।