
গ্রামের মাঝখানে কাঁচা সড়কের পাশে কাঠের চৌকিতে বসে আছেন জামাল উদ্দিন (৭২)। পাশেই পাতিল ও গামলায় সাজানো রসগোল্লা, পুরি আর আলুর ডাল। চৌকির দুই পাশে বসা বিভিন্ন বয়সী গ্রাহকদের হাতে তিনি তুলে দিচ্ছেন মিষ্টি-পুরি আর ডাল।
দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার দক্ষিণ দাউদপুর গ্রামের চণ্ডীপুরের বাসিন্দা জামাল উদ্দিন পেশায় একজন মিষ্টি বিক্রেতা। ৪০ বছর ধরে গ্রামের মানুষের কাছে বিক্রি করছেন মিষ্টি ও পুরি। সকালে তাঁর দোকানে নাশতা করতে আসেন কৃষিশ্রমিক, পথচারী, শিশু, বৃদ্ধসহ নানা বয়সী মানুষ। রসগোল্লার রসে পুরি ভিজিয়ে খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে মাঠে যান কৃষকেরা।
জামাল উদ্দিন বলেন, একসময় ৫ টাকায় বিক্রি করতেন ৬টি রসগোল্লা। কখনো আবার ২টি রসগোল্লা ও ৪টি পুরি বিক্রি করতেন এই দামে। তখন লাভও হতো ভালো। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে রসগোল্লা ও পুরির দামও। বর্তমানে ১টি রসগোল্লা ও ২টি পুরির প্যাকেজ বিক্রি করেন ২০ টাকায়। কেউ কেউ ২০ টাকায় ৪টি পুরির সঙ্গে পান বিনা মূল্যের আলুর ডাল। এতে তাঁর লাভ থাকে ৪ থেকে ৫ টাকা।
জামাল উদ্দিন বরেন, একসময় দিনে ৫০০ থেকে ৬০০টি মিষ্টি বিক্রি হতো। এখন তা নেমে এসেছে ২০০ থেকে ২৫০টিতে। আয়ও কমেছে আগের তুলনায়।
১৯৬৮ সালে স্থানীয় কাটলাবাজারের মিষ্টি কারিগর নজর উদ্দিনের কাছে কাজ শিখে শুরু হয় জামাল উদ্দিনের পথচলা। সেখানেই শিখেছেন রসগোল্লা তৈরির কৌশল, ব্যবসার অভিজ্ঞতাও। এর মাঝে কেটেছে অনেকটা জীবন। জীবিকার প্রয়োজনে করেছেন ঘরামির কাজ, কৃষিশ্রমিকের কাজ। স্থানীয় বাজারে লবণের ব্যবসাও করেছেন। পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছেন বসতভিটার এক টুকরা জমি—সেই আশ্রয়েই পেতেছেন সংসার।
১৯৮৫ সাল থেকে নিজেই বাড়িতে রসগোল্লা তৈরি শুরু করেন জামাল উদ্দিন। রাতভর তৈরি করতেন মিষ্টি ও পুরি; সকালে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করতেন। উপকরণ কিনতেন কাটলাবাজার থেকে। এই কাজে তাঁর পাশে থাকতেন স্ত্রী উম্মে কুলসুম। মিষ্টি বিক্রির আয়েই সাত সন্তানকে বড় করেছেন জামাল উদ্দিন। তাঁদের লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন।
২০২২ সালে স্ত্রী উম্মে কুলসুম মারা যান। সেই থেকে অনেকটাই একা হয়ে পড়েছেন জামাল উদ্দিন। এখন আর আগের মতো গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে পারেন না। বাড়ির সামনের রাস্তায় কাঠের চৌকিতে বসেই চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা।
জামাল উদ্দিনের দোকানে খেতে আসা ওই গ্রামের বাসিন্দা মকিম উদ্দিন (৭৪) বলেন, ‘বাড়িত নাশতা বানবার গেলে ম্যালা সময় নাগে, ম্যালা ঝামেলা। খরচও ম্যালা হয়। তাই ওগলা ঝামেলা বাদ দিয়ে জামালের দোকানোত মিষ্টি-পুরি দিয়ে নাশতা করবার আসি। মোর মতো ম্যালা মানুষ জামালের দোকানোত নাশতা করে। জামাল অনেক পুরানা দোকানদার, ভালো খাবার বানায়।’
গ্রামে চালকলে ধান ভানার কাজ করছিলেন মমিনুর রশিদ ওরফে বাবু (৪৭)। চালকলের পাশেই তাঁর বাড়ি। তিনি মিষ্টি-পুরি খেতে জামাল উদ্দিনের দোকানে এসেছেন। মমিনুর রশিদ বলেন, ‘মেলোত (চালকল) কাম করতে করতে খিদা নাগিছে। এখন নাশতা বাড়িত করবার গেলে দেরি হবে, বাড়ির এইটা-ওইটা কাম করতে ধান ভানার কাম আর হবে না। তাই জামাল ভাইয়ের দোকানোত নাশতা করবার আইছি।’
জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করিছি। ৪০ বছর ধরে মিষ্টি-পুরি বিক্রি করছি। আমার জীবনের সঙ্গে এ ব্যবসা মিশে গেইছে। বয়স হইছে, মিষ্টির ভার নিয়ে আর গ্রামে গ্রামে ঘুরতে পারি না। এখন বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে চৌকিতে বসি। আমার ব্যবসায় আমার মায়ের দোয়া আছে। আমার হাতে কখনো টাকা ফুরায় না। নাতিপুতি আর মিষ্টির দোকান নিয়ে অনেক ভালো আছি।’