
চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মর্টার শেলের হামলায় নিহত তিন বোনকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় ‘ত্রিবেণী’ চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলা শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার রাঢ়ীখাল ইউনিয়নের বালাসুর বিক্রমপুর জাদুঘর প্রাঙ্গণে এ প্রদর্শনী শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগ, যাঁরা যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতার শিকার হয়েছিলেন তাঁদের প্রতীক হিসেবে আসমা, নাজমা ও ফাতেমা নামের তিন বোনের একসঙ্গে মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনাবিস্মৃত গল্প এ প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়েছে।
নৈঋত স্টুডিওর আয়োজনে এবং মুক্ত আসর ও স্বপ্ন ৭১ প্রকাশনার সহযোগিতায় এ প্রদর্শনী শুরু হয়। আয়োজকেরা জানান, মেলা ও চিত্র প্রদর্শনীটি আগামীকাল ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে।
ত্রিবেণী চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ত্রিবেণী চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলার সদস্যসচিব আবদুল লতিফ। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বিক্রমপুর জাদুঘরের কিউরেটর নাসির উদ্দীন, শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জসিমউদ্দীন, নৈঋত স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা আয়শা জাহান প্রমুখ।
আয়োজকেরা জানান, চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মর্টার শেলের হামলায় যে তিন বোনসহ ১৬ জন শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের স্মরণ করতেই এই ত্রিবেণী চিত্র প্রদর্শনী ও জনস্বাস্থ্য মেলার আয়োজন। ইতিহাসের এই করুণ অধ্যায় নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরাই এই আয়োজনের লক্ষ্য। প্রদর্শনীতে শহীদদের ছবির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা ঘটনার চিত্র, তথ্যচিত্র ও সচেতনতামূলক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপকরণ প্রদর্শন করা হয়।
চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মর্টার শেলের হামলায় নিহত তিন বোন শহীদ আসমা, নাজমা ও ফাতেমা মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের ভাগ্যকূল এলাকার মো. সামসুল হকের মেয়ে। চিত্র প্রদর্শনীতে ওই ঘটনা নিয়ে বক্তব্য দেন শহীদ তিন বোনের বড় ভাই জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক।
অনুষ্ঠানে আলোচনা থেকে জানা যায়, অধ্যাপক মুজাহেরুল হকের বাবা সামসুল হক তাঁর চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে নিয়ে চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায় থাকতেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর বিচ্ছিন্নভাবে দেশের সর্বত্রই অস্থিরতা চলছিল।
এ সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় নেন ঘাসিয়াপাড়ার এক বাড়িতে। তাঁরাসহ সেখানে মোট আশ্রয় নিয়েছিলেন ৬৫ জন। ঘটনার দিন ৩ এপ্রিল ভোরবেলা। কেউ ঘুমে, কেউ জেগে উঠেছেন কেবল। ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত একটি মর্টার শেলের আঘাতে প্রাণ হারান আসমা বেগম, ফাতেমা বেগম। নাজমাসহ তাঁর আরও এক ভাই, এক বোন আহত হন। ওই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া আরও ১৬ জন আহত হন। তবে নাজমার অবস্থা ছিল গুরুতর। চিকিৎসার জন্য আহতদের কোথাও নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। চারপাশ ঘিরে রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় নাজমার। সেদিন আসমা বেগম ও ফাতেমাকে এক কবরে রাখা হয়। অপেক্ষা চলছিল নাজমা মরে গেলে তাঁকেও একই কবরে রাখা হবে। অবশেষে ব্যাপক রক্তক্ষরণে মারা যান নাজমাও। তিন বোনকে রাখা হয় এক কবরে। সেদিনের মর্টার শেলের আঘাতে তিন বোনের আরেক বোনের বুকের এক পাশ উড়ে যায়। তিনি এখনো বেঁচে আছেন সেই চিহ্ন নিয়ে। একইভাবে তাঁদের ছোট ভাইয়ের শরীরেও আছে শেলের চিহ্ন।
মুক্ত আসরের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আবু সাঈদ বলেন, এই প্রদর্শনী মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্যাগ স্বীকার করা মানুষের অজানা গল্পের প্রতিফলন। এটি শুধু শিল্পের জন্য নয়, বরং বিস্মৃত স্বপ্ন, সাহস ও স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অনন্য প্রয়াস। নৈঋত স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা আয়শা জাহান জানান, এ প্রদর্শনীতে উপস্থাপন করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ওই তিন বোনের ব্যবহৃত পোশাকও।
একসঙ্গে শহীদ হওয়া তিন বোনের স্মৃতি তুলে ধরা হয়েছে চিত্রকলা, ইনস্টলেশন, ভিজ্যুয়াল মাধ্যম এবং তাঁদের ব্যবহৃত পোশাকের প্রদর্শনীর মাধ্যমে। স্থান পেয়েছে মোট ২৫টি শিল্পকর্ম। তিন বোনের সাদাকালো একটিমাত্র ছবি সম্বল করে তাঁদের বিভিন্ন ধরনের ছবি এঁকেছেন শিল্পীরা। জলরং, তেলরং ও দৃশ্যমাধ্যমে তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন শহীদ আসমা, নাজমা ও ফাতেমার শৈশব থেকে শহীদ হওয়ার দিন পর্যন্ত সময়ের ঘটনা।
সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শহীদের ছোট ভাই আবদুর রহমান (বাবলু)। প্রদশর্নীতে স্থান পেয়েছে তরুণ শিল্পী প্রশুন হালদার, মৃৎমন্দির গুঞ্জন কুমার রায়, জয়তী বিশ্বাস, সারাহ জাবীনের মতো কয়েকজন শিল্পীর কাজ।