
শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে চাঁদপুর-শরীয়তপুর নৌপথের ইব্রাহীমপুর ফেরিঘাট পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের একটি প্রকল্প ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুমোদন করে সরকার। সড়কটি নির্মাণের জন্য ৯৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করাতে ৪৩১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
তবে ৪৯ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করার পর বরাদ্দের টাকা শেষ করে ফেলে জেলা প্রশাসন। ফলে টাকার অভাবে বাকি ৪৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ কাজ বন্ধ রয়েছে। এদিকে জমি বুঝে না পাওয়ায় সড়কটির নির্মাণকাজও বন্ধ হয়ে গেছে।
ওই ৩৫ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ৫ বছরে মাত্র ৬ কিলোমিটার নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ২৯ কিলোমিটার সড়ক কবে নির্মাণ হবে, তা–ও জানে না সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ।
শরীয়তপুর সওজ সূত্রে জানা যায়, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহন সহজে চট্রগ্রাম অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য ২০০১ সালে চাঁদপুর-শরীয়তপুর আঞ্চলিক সড়কটি চালু করা হয়। সড়কটি সরু ও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়লে তা প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৯–২০ অর্থবছরে জেলা শহরের মনোহর বাজার হতে ভেদরগঞ্জ উপজেলার ইব্রাহীমপুর পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার সড়ক পুনর্নির্মাণ করতে ৮৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়।
সড়ক নির্মাণের জমি অধিগ্রহণে বরাদ্দের টাকা শেষ হয়েছে, তা নিয়ে পরবর্তী করণীয় এখন বলা যাচ্ছে না। বিষয়টির সঙ্গে আরেকটি দপ্তর রয়েছে।তাহসিনা বেগম, জেলা প্রশাসক, শরীয়তপুর
জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়নি, টাকা শেষ
শরীয়তপুর-ইব্রাহীমপুর (চাঁদপুর-শরীয়তপুর আঞ্চলিক সড়ক) ৩৫ কিলোমিটার সড়কটি ৪ লেন করার জন্য ২০২০ সালে সওজ বিভাগ জেলা প্রশাসনকে ৯৫ দমমিক ৮৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের জন্য চিঠি দেয়। জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা সওজের চাহিদা অনুযায়ী ওই জমি অধিগ্রহণ করতে ৪৩১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা চাহিদা দেখিয়ে প্রাক্কলন দেন। সে অনুযায়ী সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকের বরাবরে ৪৩১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা ১৯টি এলএ কেসের মাধ্যমে বিভিন্ন মৌজার ৯৫ দমমিক ৮৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করার জন্য কাজ শুরু করে। গত ৫ বছরে ১১টি এলএ কেসের মাধ্যমে সড়কটির বিভিন্ন মৌজায় ৪৯ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাতে জেলা প্রশাসনের ব্যয় হয়েছে ৪৩০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বাকি ৪৬ দশমিক ৮৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসনের কাছে অবশিষ্ট রয়েছে ১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। কিন্তু ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য আরও ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন, যা এই মুহূর্তে প্রকল্পের ব্যয়ে ধরা নেই, যার কারণে অধিগ্রহণ কার্যক্রম থেমে গেছে।
ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে বিপাকে ক্ষতিগ্রস্তরা
৪৯ হেক্টর জমির মালিকদের জমি, স্থাপনা ও গাছপালার ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান করা হয়েছে। বাকি ৪৬ হেক্টর জমির মালিকদের ভূমি অধিগ্রহণ আইনের বিভিন্ন ধারার নোটিশ দেওয়া হলেও কাউকে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হচ্ছে না।
৫ বছর ধরে ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন জমির মালিকেরা। অধিগ্রহণ আইনে নোটিশ দেওয়ার কারণে অনেকে ভাঙাচুরা বসতঘর ও দোকানঘর মেরামত করতে পারছেন না, প্রয়োজনে জমি বিক্রি করতে পারছেন না।
সড়কটির ভেদরগঞ্জ উপজেলার পাপরাইল এলাকার ইব্রাহীম সরদারের ৬ শতাংশ জমির ওপর টিনের তৈরি বসতঘর ও দোকানঘর। ঘর দুটি জরাজীর্ণ, জমিটি সড়কের জন্য অধিগ্রহণ করায় সংস্কার করতে পারছেন না। বৃষ্টি হলেই ভেতরে পানি পরে। বাধ্য হয়ে তার মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে।
ইব্রাহীম সরদারের ছেলে রাব্বি সরদার বলেন, ৫ বছর ধরে ডিসি অফিসে ঘুরছি কিন্তু ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছি না।
থেমে গেছে সড়ক নির্মাণ-৫ বছরে ৬ কিলোমিটার সম্পন্ন
৩৫ কিলোমিটার সড়কটি বর্তমানে ৩৩ ফুট প্রশস্ত করা হবে। ৪টি গুচ্ছ প্রকল্পের (প্যাকেজ) আওতায় ২০২০ সালে আলাদাভাবে দরপত্র দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার মেয়াদ ছিল। তখন ইব্রাহীমপুর হতে বালারবাজার পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার অংশে জমি অধিগ্রহণ হওয়ায় কাজ করেছে ঠিকাদার। অন্য তিনটি প্যাকেজের কাজ ঠিকাদার শুরুই করেনি। এরপর আরও ৪ বার দরপত্র দেওয়া হয়। ওই সময়ে ৩ দফা প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়ানো হয়। বর্তমান মেয়াদ এ বছরের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হবে। চতুর্থ দফা মেয়াদ বাড়ানোর জন্য সওজ হতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালে কার্যাদেশ বাতিল হওয়া একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সড়কটির নির্মাণব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৯ সালের নির্মাণসামগ্রীর বাজারদর অনুযায়ী। বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০ হতে ৪০ শতাংশ। ওই বাজারদরে ঠিকাদার কাজ করতে আগ্রহী নয়। এ কারণে বারবার দরপত্র আহ্বান করেও ভালো ঠিকাদার পাচ্ছে না। যাঁরাও দরপত্রে অংশ নেন, তাঁরা আর কাজ করেন না। কাজটি শেষ করতে হলে নতুন দামে দরপত্র দিতে হবে। প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন ছাড়া যা মোটেও সম্ভব নয়। প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে গেলেই প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।
৩৫ কিলোমিটার সড়কের ৪ লেনের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য যে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে। আরও ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। ওই টাকা বরাদ্দ পেতে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে।
বর্তমানের সড়কটির বিভিন্ন স্থান খানাখন্দে ভরা। সাতক্ষীরা থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে নিয়মিত চট্টগ্রামে যাতায়াত করেন ট্রাকচালক মনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ট্রাক নিয়ে শরীয়তপুর অংশে আসি, তখনই দুর্ভোগ শুরু হয়। ভাঙা ও খানাখন্দকে ভরা সড়কটি পারি দিতে অনেক কষ্ট হয়। সময় ও টাকা বেশি খরচ হয়।’
শরীয়তপুর সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন বলেন, ৩৫ কিলোমিটার সড়কের ৪ লেনের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য যে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে। আরও ৩০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। ওই টাকা বরাদ্দ পেতে ডিপিপি সংশোধন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় ঠিকাদার ৩টি প্যাকেজের কাজ করেনি। তাই ২০২৩ সালে দরপত্র বাতিল করতে হয়েছে। এরপর যতবার দরপত্র দিয়েছি, ততবারই প্রকল্পে ধরা ব্যয়ের মধ্যে কাজ করতে রাজি হয়নি ঠিকাদার। তাই বারবার দরপত্র বাতিল করতে হয়েছে।
জেলা প্রশাসক তাহসিনা বেগম বলেন, সড়ক নির্মাণের জমি অধিগ্রহণে বরাদ্দের টাকা শেষ হয়েছে, তা নিয়ে পরবর্তী করণীয় এখন বলা যাচ্ছে না। বিষয়টির সঙ্গে আরেকটি দপ্তর রয়েছে। আলোচনাটা বিভাগীয় পর্যায়ে করতে হবে। এরপরে জানানো যাবে।