এক্সকাভেটরের আঘাতে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে ঘরবাড়ি। দেখে মনে হবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কয়েকটি বাড়ি। ছাউনির টিনগুলো দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে। বাড়ির লোকেরা সরাতে পারেনি কোনো জিনিসপত্র, এমনকি রান্নাঘরের ভাত-তরকারিও।
ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাবুডাইং গ্রামে গত সোমবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত। আদালতের উচ্ছেদ আদেশে আদালতের প্রতিনিধি ও থানা-পুলিশের উপস্থিতিতে কোল জনগোষ্ঠীর পাঁচটি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। পরিবারগুলোর সদস্যসংখ্যা ১৫ থেকে ২০। উচ্ছেদের পর তাঁরা একটি বাঁশঝাড়ের নিচে রাতযাপন করেছেন।
উচ্ছেদের খবর পেয়ে সোমবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সনাতন-রুমালী দম্পতির বাড়ির সবাই অভুক্ত। চোখের সামনে বাড়িঘর, জিনিসপত্রের ধ্বংসস্তূপ দেখে দুপুরে না খেয়ে থাকার কথা ভুলে গেছে সবাই। পাঁচ বছরের মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুটিও যে না খেয়ে আছে, সে কথাও ভুলে গেছে। পরিচিত এ প্রতিবেদককে দেখতে পেয়ে জিমাইল সরেন নামের শিশুটি শব্দ করে কান্না শুরু করে। ‘ভাত নাই, ভাত নাই’ বলে চিৎকার শুরু করে। ক্ষুধার্ত শিশুটির এ কান্না দেখে আঁচলে চোখ মোছেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারীরা।
জিমাইলের দাদা সনাতন সরেন ও দাদি রুমালী হাসদা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেন, ‘রান্নাঘরে ভাত-তরকারি রাঁধা ছিল। হাতে-পায়ে ধরে জিনিসপত্র সরানো জন্য আধঘণ্টা সময় চেয়েছিলাম। বলেছিলাম, জমির দাম দিয়ে দিব, উচ্ছেদ করিয়েন না। কিন্তু কথা শোনেনি।’
রুমালী হাসদা বলেন, তাঁদের পাঁচটি পরিবার খাসজমি মনে করে ২৫ বছর ধরে সেখানে বাস করছিল। এর মধ্যে ওই জমি নিজেদের দাবি করে নজরুল ইসলাম আলমগীর ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন মিলে কয়েকজন আদালতে মামলা করেন।
রুমালী হাসদার দাবি, আদালতের একতরফা রায়ে তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো নোটিশও দেওয়া হয়নি। বাড়ির আসবাব, দরজা-জানালা খুলে কিছুই সরানো যায়নি। রান্না করা খাবারও বের করতে পারেননি। সবই মাটির দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে নষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেঁদে কেঁদে রুমালী হাসদা বলেন, ‘একটি জিনিসও বাহির করতে দিলের না স্যার। ভাতের হাঁড়িটাও বাহির করতে দিলেন না। জিনিস সরাইবার লাইগ্যা দুঘণ্টা সময় চাহিয়্যাছিনু। তা-ও দিলেন না।’
উচ্ছেদ অভিযানে আসা রাজশাহী জেলা জজ আদালতের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেওয়া আদালতের নাজির বিশ্বজিৎ ঘোষ প্রথম আলোকে জানান, গোদাগাড়ী সহকারী জজ আদালতে দায়ের করা মামলায় উচ্ছেদের আদেশ দেন গোদাগাড়ী সহকারী জজ আদালতের বিচারক। এ মামলার বাদী আলমগীর কবির দিং ও বিবাদী সোনা দিং (সনাতন সরেন)। উচ্ছেদ অভিযানের সময় নাসির উদ্দিন নামে এক আইনজীবী, গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক আবুল কালাম ছিলেন।
বিশ্বজিৎ ঘোষ আরও বলেন, ‘বাড়িঘর ভাঙার আগে আমরা ভুক্তভোগীদের বলেছিলাম, বাদীর সঙ্গে সমঝোতা করে সময় নেওয়ার জন্য। কিন্তু বাদী রাজি না হওয়ায় আমরা আদালতের নির্দেশে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে বাদীকে দখল বুঝিয়ে দিয়েছি।’ মামলার বাদীদের একজন আলমগীর কবির বলেন, ‘আদালতের উচ্ছেদ আদেশ পেয়ে আমি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছি, তাঁরা নিজেরা যেন বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে সরে যান। কিন্তু তাঁরা সেটা মানেননি।’
আজ মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙাচোরা বাড়ির মাটির দেয়ালের বড় বড় খণ্ড তুলে চাপা পড়ে যাওয়া কাপড়চোপড়, মশারিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন সনাতন সরেন, রুমালী হাসদা দম্পতি ও আত্মীয়স্বজন। তাঁরা ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির পাশেই একটি বাঁশঝাড়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। রাতে তাঁরা এখানেই পাটি বিছিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। রান্নাবান্নার জন্য কচু ও আলু কাটছিল তাঁদের বউ-ঝিয়েরা। বিষণ্ন চেহারায় বাঁশঝাড়ের তলায় একপাশে বসে ছিলেন রুমালী হাসদা। তিনি বলেন, ‘কাল সারা দিন খাওয়া হয়নি বললেই চলে। রাতে মশার কামড়ে ঘুমাতে পারিনি।’
পাঁচটি পরিবারের বাসস্থান হারানোর বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহম্মেদকে অবগত করা হলে তিনি জানান, উচ্ছেদের বিষয়টি তাঁকে জানানো হয়নি। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তরা যোগাযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।