লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত আব্দুল গনির পরিবারের আহাজারি। আজ শনিবার সকালে
লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত আব্দুল গনির পরিবারের আহাজারি। আজ শনিবার সকালে

মেঘনায় লঞ্চ দুর্ঘটনা

পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা চার পরিবার

দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন আবদুল গণি (৩৮)। তাঁর আয়ে চলত পাঁচ সদস্যের পরিবার। ১০ দিন আগে ভোলায় গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। গত বৃহস্পতিবার স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকাগামী লঞ্চে ওঠেন তিনি। মেঘনার বুকে ঘন কুয়াশার মধ্যে সেই লঞ্চের সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে আসা বরিশালগামী একটি লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে গণিসহ ভোলার চার যাত্রী নিহত হন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো।

ইতিমধ্যে নিহত ব্যক্তিদের লাশ বাড়িতে ফিরেছে। জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু থেমে নেই কান্না। নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাঁদের মৃত্যুতে পরিবারগুলো মুহূর্তেই পড়ে গেছে গভীর অনিশ্চয়তায়। স্বজনদের একটাই প্রশ্ন, কীভাবে চলবে তাঁদের সংসার?

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দুলারহাট থানার ঘোষেরহাট লঞ্চঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি জাকির সম্রাট-৩। দিবাগত রাত আনুমানিক দেড়টার দিকে চাঁদপুরের হাইমচর এলাকায় ঘন কুয়াশার মধ্যে বিপরীত দিক থেকে আসা বরিশালগামী এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে চারজন নিহতের পাশাপাশি অন্তত সাত থেকে আটজন আহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন নারী ও তিনজন পুরুষ। তিনজনের বাড়ি ভোলার লালমোহন উপজেলায় ও একজনের চরফ্যাশন উপজেলায়।

নিহত আবদুল গণি লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের কাজিরাবাদ গ্রামের সিরাজুল ব্যাপারীর ছেলে। গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। খবর পেয়ে আশপাশের মানুষ বাড়িতে ভিড় করেন। স্ত্রী লাইজু বেগম তিন শিশুসন্তানকে নিয়ে স্বামীর মরদেহের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কান্না জড়ানো কণ্ঠে লাইজু বেগম বারবার প্রশ্ন করছিলেন, ‘সন্তানগুলোর এখন কী হবে? কে তাঁদের দেখবে?’

লঞ্চ দুর্ঘটনায় একই গ্রামের সাজু খাঁ নামের এক দিনমজুর মারা গেছেন। তিনি একই গ্রামের কালু খাঁর ছেলে। তাঁর লাশও শুক্রবার রাতে আসে। আবদুল গণি ও সাজু—দুজনেরই নিজেদের কবরস্থানের জমি না থাকায় অন্যের কবরস্থানে তাঁদের দাফন করতে হয়েছে। আজ শনিবার সকালে দুজনকে জানাজা শেষে আবদুল মান্নান মিয়া বাড়ির কবরস্থানে দাফন করা হয়।

লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত (বাঁ থেকে) আব্দুল গণি, সাজু খাঁ ও রিনা বেগম। নিহত অন্য ব্যক্তির ছবি পাওয়া যায়নি

মেয়েকে তুলে দেওয়া হলো না সাজুর

নিহত সাজু খাঁ দিনমজুর ছিলেন। দিনমজুরি করেই কোনোমতে সংসার চলত। তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছোট মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন ১০ দিন আগে। ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, একজনের কাছ থেকে পাওনা টাকা এনে মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে তুলে দেবেন। এর আগেই দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। ছেলেদের একজনের বয়স আট বছর, অন্যটির দুই বছর। সাজুর বাবাও বেঁচে নেই।

সাজুর স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৩৫) বলেন, ‘আমি কীভাবে মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে তুলে দেব? কীভাবে এই ছোট ছেলেদের মানুষ করব! কিছুই বুঝতে পারছি না।’

লঞ্চ দুর্ঘটনায় একই গ্রামের মো. মিলন বিশ্বাস ও মো. শাহাদাৎ গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁরা ঢাকায় চিকিৎসাধীন। তাঁদের বাড়ি একই গ্রামের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজিরাবাদ এলাকায়।

মাকে হারিয়ে দিশেহারা মেয়ে

লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন লালমোহনের কচুয়াখালী গ্রামের লাল মিয়া গাজি বাড়ির পোশাককর্মী রিনা বেগম (৩৫)। শনিবার সকাল ১০টায় তাঁর লাশ বাড়িতে পৌঁছায়। বেলা ১১টায় কচুয়াখালী গ্রামের জলিমান হাজিবাড়ি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা হয়। দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামী মোহাম্মদ হোসেনও গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁর নাক ফেটে গেছে। বুকে ও পায়ে আঘাত পেয়ে শয্যাশায়ী অবস্থায় আছেন।

রিনা বেগম ও তাঁর স্বামী সাত থেকে আট বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করতেন। তিনি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ইচ্ছে ছিল একমাত্র মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা সাথী আক্তার গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদির কাছে থাকত। সে কচুয়াখালী মহিলা মাদ্রাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছে সাথী।

চার সন্তান নিয়ে বিপাকে রহিমা

অন্যদিকে স্ত্রীকে চিকিৎসা দিতে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলেন চরফ্যাশনের মো. হানিফ শনি। নিজের কোনো জমি না থাকায় উপজেলার দুলারহাট আহাম্মদপুর ইউনিয়নের ফরিদাবাদ গ্রামের তেঁতুলিয়া তীরের বাঁধের ওপর বাস করতেন তিনি। চার ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন। কখনো নদীতে ভাগি হিসেবে মাছ ধরতেন, কখনো দিনমজুরি করতেন। গত বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি।

চিকিৎসা না করেই রহিমা বেগম স্বামীর লাশের সঙ্গে শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাড়িতে ফেরেন। শনিবার সকাল আটটায় দালালবাড়ি জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।

ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. সালাউদ্দিন ও নিহত ব্যক্তির ভাই মো. আরিফ হোসেন জানান, রহিমা বেগম এখনো গুরুতর আহত। কথা বলতে পারেন না, জোরে কাঁদতেও পারেন না। শুধু নীরবে চোখের পানি ফেলছেন। তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে এখন বিপদে পড়েছেন।

সহায়তার অপেক্ষায় পরিবারগুলো

স্থানীয় লোকজন জানান, নিহত প্রত্যেকেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতেন। দিনমজুরের কাজ না করলে পরদিন তাঁদের চুলা জ্বলে না। কারও তেমন কোনো সম্পত্তি নেই। এমন পরিবারগুলোর এখন দ্রুত সহায়তা প্রয়োজন।

লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আজিজ বলেন, জেলা প্রশাসনের জিআর তহবিল থেকে নিহত প্রতিটি পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের চিকিৎসার জন্য ১৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে বরাদ্দ এলে আরও সহায়তা দেওয়া হবে।