দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ

৩০ শতকে ধান চাষে সার খরচ ৩২০ টাকা, ফলনে খুশি কৃষকেরা

‘জিরো বাজেট ন্যারারাল ফার্মিং’ প্রকল্পের সুবিধাভোগী কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন সিসিডিবির এলাকা ব্যবস্থাপক হরিসাধন রায়। সম্প্রতি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কান্দ্রুপাড়ায়
ছবি: প্রথম আলো

৩০ শতক জমিতে এবার ‘বাবু কাটারি’ জাতের ধান আবাদ করেছিলেন দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কান্দ্রুপাড়া গ্রামের কৃষক জগেশ টপ্য। সেখানে তাঁর সার বাবদ খরচ হয়েছে মাত্র ৩২০ টাকা, অন্যবার খরচ হতো প্রায় ৬ হাজার টাকা। জগেশ বলেন, এবার কম খরচ করেও পাশের জমির তুলনায় তাঁর জমির আবাদ কোনো অংশেই খারাপ হয়নি। তিনি ২২ মণ ধান পেয়েছেন।

‘জিরো বাজেট ন্যাচারাল ফার্মিং’ বা ‘শূন্য খরচ প্রাকৃতিক আবাদ’ প্রকল্পের মাধ্যমে এই ধান আবাদ করেছিলেন জগেশ টপ্য। তাঁর মতো নবাবগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের ৮টি গ্রামের ৬০ জন কৃষক চলতি মৌসুমে এই প্রকল্পের আওতায় আবাদ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। তাঁরা সবাই পানি, গোবর, গোমূত্র, চিটাগুর, ডালের বেসন ও মাটি দিয়ে তৈরি করা সার ব্যবহার করেছেন। কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘দশপর্ণী অর্ক’ নামের বাড়িতেই তৈরি আরেক ধরনের উপাদান।

সমন্বিত দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির মাধ্যমে এসব কৃষককে পরামর্শ ও উপকরণ (প্লাস্টিকের ড্রাম) সহায়তা দিচ্ছে বেসরকারি সংস্থা খ্রিস্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি)। সংস্থাটি বলছে, প্লাস্টিকের ১টি ড্রামে ১০০ লিটার পানি, ১০ কেজি কাঁচা গোবর, ৫ লিটার গোমূত্র, ৩৫০ গ্রাম চিটাগুড় ও ৩৫০ গ্রাম ডালের বেসন এবং এক মুঠো মাটি (রাসায়নিক সারমুক্ত) দিয়ে তৈরি হয় ‘জীবাণু সারের’ মিশ্রণ। জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ধানগাছে বিছা (থোর) আসা পর্যন্ত জমিতে দুই থেকে তিনবার এই সার ছিটানো হয়। প্রয়োজন হলে ছিটানো হয় ভেষজ কীটনাশক হিসেবে দশপর্ণী অর্ক। এক বিঘা জমিতে জীবাণু সার ও কীটনাশকে ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা খরচ হচ্ছে।

জমিতে প্রাকৃতিক সার ব্যবহার করলে জমি উর্বর হয়, জমির পানির ধারণক্ষমতা বেড়ে যায় এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ কমে যায়। এতে কৃষকের আর্থিক সাশ্রয় হয়।
রাকিবুল হাসান, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর

গত আমন মৌসুমে সংস্থাটির পরামর্শে দাউদপুরের চারজন কৃষক প্রথম এ পদ্ধতিতে ধান চাষ করে ভালো ফলন পান। পরে তাঁদের দেখাদেখি চলতি বোরো মৌসুমে এলাকার ৬০ জন কৃষক ধান ও বিভিন্ন সবজি চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন। এ পদ্ধতিতে ফসল ফলিয়ে কৃষকেরা পেয়েছেন বিষমুক্ত ও নিরাপদ ফসল। এতে করে আগামী আমন মৌসুমে এ পদ্ধতি কাজে লাগানো কৃষকের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছেন প্রকল্পে সহায়তাকারী সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা। ধানের পাশাপাশি সবজিসহ অন্য ফসল উৎপাদনেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করছেন কৃষকেরা।

সিসিডিবি সূত্রে জানা গেছে, এলাকার পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কৃষি ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কর্মসূচিতে ভারতের মহারাষ্ট্রের কৃষিবিদ সুভাষ পালেকারের ‘জিরো বাজেট ন্যাচারাল ফার্মিং’ পদ্ধতিটি কাজে লাগানো হচ্ছে। দরিদ্র কৃষকেরা বাড়িতেই নামমাত্র খরচে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রস্তুত করা সার ও কীটনাশক জমিতে ব্যবহার করছেন। জৈব কীটনাশক তৈরি করতে দশপর্ণী অর্ক ফর্মুলায় হলুদ, আদা, রসুন, কাঁচামরিচ, বিভিন্ন গাছের পাতাসহ ১০ রকমের ভেষজ উপাদানের মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়।

পানি, গোবর, গোমূত্র, চিটাগুর, ডালের বেসন ও মাটি দিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে সার। সম্প্রতি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নে

সরেজমিনে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষের জন্য তিনবার এ জীবাণু সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। প্রথমে জমি প্রস্তুতের সময় একবার, চারার বয়স ২০ থেকে ২৫ দিন হলে একবার এবং ধানগাছে ছড়া (থোর) আসার সময় একবার। পোকার আক্রমণ হলে সেখানে দশপর্ণী অর্ক ছিটানো হয়। চিটাগুড় ও ডালের বেসন বাদে কাঁচা গোবর ও গোমূত্র বাড়িতে পালন করা গরু থেকেই সংগ্রহ করছেন কৃষকেরা। এতে অর্থেরও সাশ্রয় হচ্ছে।

প্রকল্পভুক্ত কৃষকদের ৯৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কৃষক। দাউদপুর ইউনিয়নের খিদিরপুর গ্রামের কৃষক বাবলু লাকড়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ১০ শতক জমিতে এবারই প্রথম জিরো বাজেট পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে ধান চাষ করেছি। কোনো কীটনাশক ব্যবহার করিনি। ধানের মৌসুমে এলাকায় শিলাবৃষ্টি হলেও কম খরচে ধানের আবাদ ভালো হয়েছে।’

সিসিডিবির এলাকা ব্যবস্থাপক হরিসাধন রায় প্রথম আলোকে বলেন, এ পদ্ধতিতে ধান চাষ করায় জমিতে বিভিন্ন ধরনের উপকারী অনুজীব ও কেঁচোর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এতে জমির মাটি নরম ও উর্বর থাকে। সে ক্ষেত্রে কৃষক পরবর্তী মৌসুমে যে ফসলই আবাদ করুক না কেনো, ওই জমিতে সারের ব্যবহার অনেক কম হবে। এর ফলে কৃষক আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হবেন। এ ছাড়া এ পদ্ধতিতে ফসল আবাদের ফলে কৃষক বিষমুক্ত ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে পারছেন।

প্রাকৃতিক উপায়ে সার ও কীটনাশক তৈরি করে ফসল আবাদ সম্পর্কে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এটি নিঃসন্দেহে জমি ও ফসলের জন্য ভালো দিক। জমিতে প্রাকৃতিক সার ব্যবহার করলে জমি উর্বর হয়, জমির পানির ধারণক্ষমতা বেড়ে যায় এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ কমে যায়। এতে কৃষকের আর্থিক সাশ্রয় হয়।