
কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা—এই ৩ নদ-নদীর ১৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ঘেরা খুলনার কয়রা উপজেলা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিয়ন্ত্রণাধীন ওই বেড়িবাঁধ কেটে কিংবা ছিদ্র করে নদীর লোনাপানি ঢুকিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েক হাজার অপরিকল্পিত চিংড়িঘের, এতে দুর্বল হচ্ছে বাঁধ। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। মানুষ বসতভিটা হারানোর পাশাপাশি লোনাপানির বিরূপ প্রভাবে উজাড় হচ্ছে বনজ ও ফলদ সম্পদ, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
এ কারণে আজ বুধবার সকালে পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও নৌবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে বেড়িবাঁধ ছিদ্র করে বসানো চিংড়িঘেরের অবৈধ পাইপ অপসারণ শুরু করেছে। অভিযানের প্রথম দিন কয়রা উপজেলার হাজতখালি এলাকা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ২৭টি চিংড়িঘেরের পাইপ অপসারণ করা হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে কয়রার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কয়রা উপজেলার গেবরা, মদিনাবাদ, লোকা, মঠবাড়ি, দশালিয়া, হোগলা, মহেশ্বরীপুর, তেঁতুলতলারচর, বানিয়াখালী, হড্ডা, চৌকুনি, বাবুরাবাদ, কাটকাটা, কাটমারচর, ৬ নম্বর কয়রা, চরামুখা, জোড়শিং এলাকার ঘের ব্যবসায়ীরা চিংড়িঘেরে লোনাপানি ওঠাতে যথেচ্ছভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে কাটাছেঁড়া করেছেন। এতে কয়েকটি ঘেরের সামনে নতুন মেরামত করা বাঁধও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান মাসুম বিল্লাহ বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বাঁধের যেসব স্থান ছিদ্র করে পাইপ বসানো রয়েছে, সেসব স্থান ভেঙে যায়। এতে কেবল সাধারণ মানুষেরই নয়, সরকারেরও কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এলাকায় মাইকিং করে লবণপানি ঢোকানোর পাইপ সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিলেও তা অগ্রাহ্য করছেন ঘেরমালিকেরা।
কয়রার মহারাজপুর এলাকার বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ‘আমরা বারবার বাঁধ রক্ষার জন্য লবণপানির চিংড়িঘের বন্ধ করার দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেছি। এরপরও ঘের ব্যবসায়ীরা বাঁধ কেটে লোনাপানি তোলা অব্যাহত রেখেছেন। এতে এলাকার জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ জীবিকা হারিয়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত মানুষেরা এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছেন।’
খুলনা পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী মশিউল আবেদীন বলেন, ‘কয়রার কয়েকটি স্থানের বাঁধের পাইপ অপসারণের মধ্য দিয়ে আমরা বাঁধ রক্ষার কাজ শুরু করেছি। এর আগে চিংড়িচাষিদের একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু কেউ পাইপ অপসারণ না করায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার সর্বত্র অভিযান চলবে। চিংড়ি চাষ করার জন্য বাঁধের ক্ষতি করতে দেওয়া হবে না। এর জন্য পরিকল্পিত পন্থায় বৈধভাবে পানি তোলার ব্যবস্থা করতে হবে।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেজেএস (জাগ্রত যুব সংঘ) ২০১৮ সালে কয়রার বাঁধ নিয়ে জরিপ করে। জরিপে উঠে আসে, কয়রা উপজেলায় চিংড়ি চাষের জন্য বাঁধের ৫২১ জায়গায় কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। পাইপ বসানোর কারণে বাঁধের কাটা স্থানগুলো খুবই দুর্বল হয়ে পড়ায় সামান্য জোয়ারের চাপেই তা ভেঙে এলাকা প্লাবিত করছে।
পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, ‘কয়রায় আমরা লবণপানি তুলতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। বেড়িবাঁধ ছিদ্র না করতে বারবার মাইকিং করেছি। বাঁধের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনো ঘের না থাকার নির্দেশনা আছে। আমরা অভিযান চালিয়ে পাইপ অপসারণ শুরু করেছি। যাঁরা অবৈধভাবে বাঁধ কেটে বা ছিদ্র করে লোনাপানির চিংড়ি চাষ করছেন, তাঁদের তালিকা করা হচ্ছে। দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’