
সত্তর দশকের দিকে রাজকুমার পাল ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলে অন্যতম সেরা প্রতিমাশিল্পী। তাঁর মৃত্যুর পর পারিবারিক ঐতিহ্যের এই পেশার হাল ধরেন তাঁর ছেলে সুনীল পাল। উত্তরাধিকার সূত্রে এখন কাজটি করে যাচ্ছেন তাঁর ছেলে সঞ্জিত পাল (৪৮)।
নব্বই দশক থেকে সঞ্জিত প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। তাঁর দাবি, একা হাতেই ৫০ হাজারের বেশি প্রতিমা গড়েছেন তিনি।
সঞ্জিত পালের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার কালামৃধা এলাকায়। তাঁরা দুই ভাই ও দুই বোন। ছোট ভাই রণজিৎ পাল স্থানীয় একটি কলেজের হিসাবরক্ষক হলেও সঞ্জিতকে প্রতিমা তৈরিতে সহযোগিতা করেন। তাঁদের বাবা সুনীল পাল বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তবে থেমে যাননি, বাড়িতে বসেই এখনো ছোট আকারের প্রতিমা গড়েন নিজ হাতে।
বংশপরম্পরায় সঞ্জিত এই পেশা পেলেও নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তাঁকে এই অবস্থানে আসতে হয়েছে। শিল্পের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় তিনি আগলে রেখেছেন পেশাটি। বারো মাসই নিপুণ হাতে প্রতিমা গড়েন তিনি। দুর্গাপ্রতিমা ছাড়াও রাধাকৃষ্ণ, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, মনসাসহ প্রায় সব দেব-দেবীর প্রতিমা গড়ার দক্ষতা আছে তাঁর। আবার রংতুলিতে দেবীকে মূর্ত করেন তিনিই।
বাবার মতোই সঞ্জিত প্রতিবছর মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের বিভিন্ন মণ্ডপে দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়ার কাজ করেন। চলতি বছরও এসব জেলার ১৩টি মণ্ডপে প্রতিমা তৈরি করেছেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করেন ৮ জন শিল্পী। তাঁরা প্রতিমা তৈরির নানা কাজে সঞ্জিতকে সহযোগিতা করেন।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুর শহরের ২০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী পোদ্দারবাড়ী দুর্গামন্দিরে দেখা হয় সঞ্জিত পালের সঙ্গে। তিনি জানান, মণ্ডপটিতে ২০ বছর ধরে দুর্গাপ্রতিমা গড়ে আসছেন তিনি। উৎসবটিকে ঘিরে তাঁকে টানা তিন মাস তুমুল ব্যস্ততায় কাটাতে হয়। চলতি বছরে মণ্ডপগুলোতে দুর্গাপ্রতিমা গড়ার কাজ প্রায় শেষের পথে। আজ শনিবার রাতের মধ্যেই এগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। কারণ, আগামীকাল রোববার ষষ্ঠীর বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। মণ্ডপভেদে তিনি চলতি বছর ২০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা মজুরিতে প্রতিমা গড়ার কাজ করেছেন। সবগুলোর কাজ শেষে তাঁর আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার মতো আয় থাকবে।
সঞ্জিত পালের দাবি, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা ও ঠাকুরদাদার সঙ্গে প্রতিমা তৈরির জন্য হাতে তুলে নেন মাটি। প্রথমে মাটি মাখার কাজ করতেন। কয়েক দিন সেই কাজ করার পর তাঁকে কাঠের স্ট্রাকচার তৈরি করতে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে খড়ের বেণি তৈরি, এর ওপর মাটির প্রলেপ যুক্ত করা, অবয়ব তৈরি এবং শেষ পর্যায়ের কাজসহ প্রতিমার রং, পোশাক পরানো, গয়না লাগানো ও সবার শেষে চক্ষুদানের কাজও শেখেন। এভাবে তিনি পুরোদমে প্রতিমাশিল্পী হয়ে ওঠেন ১৭ বছর বয়স থেকে।
পেশাটির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে সঞ্জিত পাল বলেন, ‘প্রতিমা গড়ার কাজে আনন্দ পাই। এই কাজকে ভালোবাসি বলেই এখনো টিকে আছি। না হলে উপকরণের দাম যেভাবে বেড়েছে, সে অনুযায়ী প্রতিমার দাম খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না। কেবল ভাবি, যদি প্রতিমা তৈরির কাজ বন্ধ করে দিই, তাহলে মানুষ পূজা করবে কী করে?’