
পদ্মার তীরে জেলেদের নোঙর করা কয়েকটি নৌকা। মাঝনদী থেকে আসা জেলেদের এসব নৌকা পাড়ে ভিড়তেই ক্রেতাদের হাঁকডাক। কেউ বলছেন, ইলিশের কেজি কত? কেউ বলছেন, জোড়া কত? আবার কেউ জানতে চাইছেন, থালায় যা আছে ‘ঠিকা’ কত? এভাবেই দরদাম করে জেলেদের কাছ থেকে ব্যাগভরে ইলিশ কিনছেন ক্রেতারা।
এ চিত্র গতকাল শুক্রবার বিকেলে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার পদ্মা নদীবেষ্টিত বন্দরখোলা ইউনিয়নের কাজিরসূরা এলাকার। এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রকাশ্যে অস্থায়ী হাট বসিয়ে ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে। এ ছাড়া নদীবেষ্টিত বন্দরখোলা, মাদবরেরচর, চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের অন্তত আরও চারটি এলাকায় এভাবে ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে।
শিবচর উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে কাজিরসূরা এলাকা। এখানে ইলিশ কিনতে এসেছেন ব্যবসায়ী দেলোয়ার সাঈদ। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাজারে তো ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞার সময় পদ্মার পাড়ে তাজা ইলিশ কম দামে পাওয়া যায়। তাই এখানে আসছি। এখানে ছোট-বড় সব ধরনের ইলিশ আছে। আমার মতো এখানে অনেকেই ঠিকায় মাছ কিনছে।’
মা ইলিশ রক্ষায় ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ শিকার, ক্রয়, পরিবহন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কর্মসূচি বাস্তবায়নে মৎস্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অংশ নিচ্ছে। তবে এর মধ্যেই অবৈধভাবে পদ্মায় ইলিশ শিকার চলছে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরও ইলিশ কেনার বিষয়ে ব্যবসায়ী দেলোয়ার সাঈদ বলেন, ‘এত আইন দিয়ে তো কেউ আর চলে না। আমরা আগেও এখানে আসছি, ইলিশ কিনে চলে গেছি। কেউ তো কিছু বলে নাই। তাহলে এখন আপনারা এসব বলছেন কেন?’
ছোট-বড় মিলিয়ে আটটি ইলিশ ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনেছেন ইকবাল হোসেন নামের আরেক ক্রেতা। তিনি বলেন, ‘সবার মতো আমরাও এখানে মাছ কিনতে এসেছি। ১ হাজার ৩০০ টাকার মাছ কিনেছি। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জেলেরা মাছ ধরে বিক্রি করতে আসেন, তাই আমরা মাছ কিনি। জেলেরা না এলে তো আমরা মাছ কিনতে আসতাম না।’
শিবচর উপজেলা মৎস্য অফিসের সূত্র জানায়, ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে পদ্মা নদীর ১২ কিলোমিটার অংশে অভিযান পরিচালনা করছে শিবচর মৎস্য বিভাগ। যৌথ বাহিনীর সমন্বয়ে তিনটি দল ২৪ ঘণ্টাই পদ্মায় অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছে। গত ১৩ দিনে অভিযান চালিয়ে ৭ লাখ ৪০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল ধ্বংস করা হয়েছে। এ ছাড়া ৪৩ জেলেকে আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও ২ লাখ ৪১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানে জব্দ করা ৩৭০ কেজি ইলিশ বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিতরণ করা হয়েছে।
শিবচর উপজেলায় এবার কার্ডধারী ২ হাজার ৬৮০ জেলেকে ২৫ কেজি করে ৬৭ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পদ্মা নদীর তীরবর্তী পাঁচটি ইউনিয়নে ১ হাজার ৪৯৪ জন জেলে রয়েছেন।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, পদ্মায় নিয়ম করে অভিযান চললেও তা অনেকটা ঢিলেঢালা। নদীবেষ্টিত হাটগুলোয় পুলিশ ও প্রশাসনের তদারকি নেই। তাই জেলেরা সুযোগমতো মাছ শিকার করে তা অনেকটা প্রকাশেই হাট–বাজারে এনে বিক্রি করছেন।
এ বিষয়ে শিবচর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সত্যজিৎ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সোমবার কাজিরসূরাসহ বিভিন্ন অস্থায়ী হাটে সেনাবাহিনী নিয়ে আমরা অভিযান করেছি। এখন আবার সেখানে হাট বসেছে। আবারও আমরা অভিযান চালাব। কাজিরসূরাতেই মূল ইলিশের হাট বসে। সীমিত লোকবল নিয়ে তো সব ধরনের অভিযান করা সম্ভব নয়।’
পদ্মায় নিয়ম করে অভিযান চললেও তা অনেকটা ঢিলেঢালা। নদীবেষ্টিত হাটগুলোয় পুলিশ ও প্রশাসনের তদারকি নেই। জেলেরা সুযোগমতো মাছ শিকার করে তা অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি করছেন।
গতকাল বিকেলে পদ্মা নদীর শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের চরচান্দ্রা, চরজানাজাত ইউনিয়নের পদ্মা নদীর বুকে জেগে ওঠা হিরা খাঁরঘাট, মাদবরের চর ইউনিয়নের পুরাতন কাওড়াকান্দি ফেরিঘাট, একই ইউনিয়নের বড়বাড়ির পেছনে পুরানকান্দি এলাকায়, বন্দরখোলা ইউনিয়ন কাজিরসূরা বাজারসংলগ্ন নদীর তীরবর্তী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব অস্থায়ী হাটে জেলেরা নৌকা নিয়ে আসেন। নৌকা থেকেই ইলিশ বিক্রি করে দিচ্ছেন পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে। ওই বিক্রেতারা নদীর পাড়ে ডালি সাজিয়ে বসেছেন মাছ নিয়ে। সেখান থেকে সাধারণ ক্রেতারা দরদাম করে কিনছেন ইলিশ। পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও আসছেন ইলিশ কিনতে।
এসব ইলিশ কেজি ছাড়াও সংখ্যা বা জোড়া হিসেবেই বেশি বিক্রি হচ্ছে। হাটে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ জেলেরা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা ও ছোট ইলিশ ৩০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন।
কাজিরসূরা এলাকার জেলে আব্বাস মাদবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কার্ড পাই না। চাউল পাই না। কোনো সাহায্য–সহযোগিতা পাই না। তাই বাধ্য হয়ে ইলিশ ধরতে আসছি। মাছ না ধরলে খাব কী? পুলিশ আসে, ধাওয়া দেয়। এর মধ্যেই আমরা ঝুঁকি নিয়া জাল ফেলি।’
ইলিশ বিক্রেতা মো. মাসুদ নামের আরেক জেলে বলেন, ‘গাঙ্গের পাড়ে মানুষ আসে। আমরা জেলেদের থেকে মাছ কিইনা বেচি। পুলিশ আসলে সবাই পালাইয়া যায়। পরে আবার আসে। এভাবেই চলে যাইতাছে।’
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এইচ এম ইবনে মিজান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মা ইলিশ রক্ষায় আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। অস্থায়ী হাটগুলো কিছুটা দুর্গম এলাকায় ও প্রচুর মানুষের ভিড় থাকায় সেখানে অভিযান চালানো কঠিন। সেনাবাহিনী নিয়ে আমরা একবার হাটগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছি। এরপরও ইলিশ কেনাবেচা চলছে।’
ইউএনও আরও বলেন, ‘এবার আমরা ক্রেতাদের ঠেকাতে চেকপোস্ট বসানো উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে দুজন ক্রেতাকে আটক করে জরিমানা করা হয়েছে। জেলেদের পাশাপাশি যাঁরা মাছ ক্রয় করতে আসবেন, তাঁদেরও আমরা আইনের আওতায় আনব।’
জানতে চাইলে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. হাদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পদ্মা নদীর পশ্চিম অংশে আমরা সকাল, বিকেল ও রাতে অভিযান পরিচালনা করেছি। ইতিমধ্যে আটটি ট্রলার, একটি স্পিডবোট জব্দ করেছি। ৪৩ জেলেকে আটক করা হয়েছে। ইলিশ রক্ষায় নদীতে ২৪ ঘণ্টা অভিযান ও পাহারা দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের লোকবল কম থাকায় সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না।’