আলমডাঙ্গায় শীতে জবুথবু বেদেবহর

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে তাবু পেতেছে বেদে সম্প্রদায়ের একটি দল। শৈত্যপ্রবাহে জীবন জবুথবু হলেও তাঁদের পাশে শীতবস্ত্র নিয়ে আসেনি কেউ। মঙ্গলবার তোলা ছবি
প্রথম আলো

‘খালি অ্যাককান পাতলা খ্যাতা গায় দিই, তাই জারে টেকতি পারি না। গরিপ মানুষ, অত টাকা কনে পাওয়া যায় যে কম্বল কিনে গায় দেব?’ আট মাস বয়সী শিশু মোহনার শরীরে তেল মাখতে মাখতে এভাবেই কথা শুরু করেন বেদে নারী ময়না খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কষ্টের কতা বুঝবে, তেমন লোক নাই।’

ময়না খাতুন একা নন, বেদেবহরে থাকা শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুদের শীত নিয়ে কষ্টের গল্পগুলো অনেকটাই কাছাকাছি। আট দিন আগে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে তাঁবু পেতেছে বেদে সম্প্রদায়ের একটি দল। এখানে আসার পর থেকেই তীব্র শীত মোকাবিলা করে এবং কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে তাঁদের সময় পার করতে হচ্ছে। তাঁদের অভিযোগ, সরকারি-বেসরকারিভাবে কম্বল ও শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও তাঁদের দিকে কেউই সহযোগিতার হাত বাড়ায়নি।

এদিকে এক দিন বিরতি দিয়ে চুয়াডাঙ্গায় আবারও ফিরে এসেছে শৈত্যপ্রবাহ। আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল মঙ্গলবার সকাল নয়টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা অনুযায়ী আজ বইছে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। গত সোমবার জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোববার দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল জেলায়। এর আগে বৃহস্পতিবার ৯ দশমিক ২ ডিগ্রি, শুক্রবার ৯ ডিগ্রি এবং শনিবার ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল।

গতকাল সকাল সাড়ে আটটার দিকে কৃষ্ণপুর গ্রামে মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে বেদেদের তাঁবুর কাছে গেলে তিন থেকে সাত বছর বয়সী একদল শিশু ছুটে আসে। এসব শিশুর কারও গায়ে ছেঁড়া-পুরোনো জামা, কারও গায়ে পুরোনো সোয়েটার, আবার বেশ কিছু শিশুর গায়ে কোনো পোশাকই দেখা যায়নি।

এই শিশুদের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে আসেন বেদেবহরের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য ১১৫ বছর বয়সী সলেমান সওদাগর। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা বাপ-দাদার কাইলে চৈদ্দ পুরুষ ধইরা এই সাপের ব্যবসা করি। শীতির সুমায় সাপ মিলতিছে না। সাপের খেলা কইরে, সাপ বিক্রি কইরে জান বাঁচায়। ঢাকায় সাপ বিক্রি করি। সাপের বিষ থেকে ওষুধ হয়। বাইল-বাচ্চা লিয়ে একেকটা পরিবারে চার থেকে আটজন সদস্য আছে। শীতির ঠেলায় বাইরে যাওয়া যাচ্চে না। খাইয়ে না খাইয়ে কুনু পুরুকার জান বাঁচাইতেচি।’

একই বহরের সবচেয়ে বয়স্ক নারী কল্পনা বেগম বলেন, ‘কী করব, আমরা গরিব মানুষ, সমস্যা হলে আল্লাহ যে ভাবে রাখেন, সে ভাবেই থাকতি হয়। যেখানে খ্যাতা লাগবে দুডো, সেখানে একটা গায়ে দিই টানাটানি হয়।’

বেদেবহরের তরুণ সদস্য হামিদুল হক। তিনি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। বেদেপল্লির মধ্যে তাঁর স্ত্রী কবিতা খাতুন সবচেয়ে বেশি নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। হামিদুল বলেন, ‘এখন আর শিঙা লাগানো, তাবিজ–কবজের ব্যবসা হয় না। মহিলারা গ্রামে যায়, চাল-টাইল তুলে আনে। সাহায্য তুলে আনে আরকি। কষ্টে দিনটুক কাইটে যাইতেচে।’

বেদেবহরটির সরদার আবদুল মান্নান সওদাগার বলেন, ‘ঠান্ডার সুমায় মনে করেন মহিলার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে যাতি পারে না। শিঙা লাগায়, তাবিজ-কবজ বেচা ব্যবসা, এখন ব্যবসা পাতলা হয়। সব মিলে বেদেদের খুব কষ্টে সময় কাটছে।’

বেদেবহরটির দুর্ভোগের কথা শোনে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের জন্য সম্ভাব্য সহযোগিতা করা হবে।