
সোমবার বেলা ১১টা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটক। সামনে অসংখ্য গাড়ি থেমে আছে। এসব গাড়ি থেকে বারবার হর্ন বাজানো হচ্ছে। শুধু বাইরের রাস্তাতেই নয়, হাসপাতালের ভেতরে যাওয়া অটোরিকশাসহ অন্যান্য গাড়ি থেকেও পাওয়া যাচ্ছে হর্নের শব্দ।
নগরের লক্ষ্মীপুরের এই এলাকায় আরও রয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস। রাস্তার দক্ষিণ পাশে রয়েছে বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার, একটি উচ্চবিদ্যালয়। আর রাস্তার দুই ধারে বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে অসংখ্য। পরিবেশ অধিদপ্তর এই এলাকাসহ ঘোষপাড়া, লক্ষ্মীপুর মোড় ও সিঅ্যান্ডবি মোড়কে অনেক আগেই ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কাগজে-কলমে এলাকাটি নীরব থাকার কথা থাকলেও উচ্চ শব্দে ভরপুর থাকে দিন ও রাতের বেশির ভাগ সময়।
রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি তাঁর আত্মীয়কে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালের এখানে এলেই গাড়ির শব্দ হয়। গাড়িগুলো থেমে থেকেও হর্ন বাজায়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে অটোরিকশাও হর্ন দিচ্ছে, আনসার সদস্যরাও বাঁশি বাজাচ্ছে। অন্তত হাসপাতালের সামনের জায়গাটুকুতে হর্ন বাজানো বন্ধ করা যেত।
নগরের বাসিন্দা, পরিবেশবাদী আন্দোলনের কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজশাহী শহরে কয়েক বছর আগেও এত শব্দদূষণ ছিল না। নগরজুড়ে অবকাঠামোসহ বিভিন্ন নির্মাণ, শহরে অটোরিকশার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, ট্রাফিক সিগন্যাল না থাকা, প্রশাসনের তদারকি ও জনসচেতনতার অভাবে শব্দদূষণ বেড়ে চলেছে। এতে করে নগরের মানুষ নীরবেই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হচ্ছেন। দ্রুত এই শব্দ নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারলে এটি আরও আশঙ্কাজনক হারে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
২০২২ সাল থেকে রাজশাহী শহরে শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করছে বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নামে একটি সংগঠন। তাদের পরীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছরই শহরটিতে শব্দের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শব্দের তীব্রতা নিয়ে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির (২০২২) প্রকাশ করা ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্রেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের প্রথম এবং রাজশাহীকে বিশ্বের চতুর্থ শব্দদূষণকারী শহর হিসেবে দেখানো হয়। যেখানে রাজশাহীতে শব্দের পরিমাণ দেখানো হয় ১০৩ ডেসিবেল। এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তখন থেকে প্রতিবছর শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে আসছে ওই সংগঠন। স্থানীয় পরীক্ষায় শব্দের মাত্রা ১০০ ডেসিবেলের বেশি না পাওয়া গেলেও কাছাকাছি পাওয়া গেছে।
যেমন শহরে শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বরে (রেলগেট) গত ৪ বছরে শব্দের মাত্রা বেড়েছে ৭ ডেসিবেলের বেশি। ২০২২ সালে এই চত্বরে শব্দের মাত্রা ছিল ৯০ ডেসিবেল। গত শনিবার (১০ মে) একই স্থানে শব্দের মাত্রা মেপে পাওয়া গেছে ৯৭ দশমিক ২ ডেসিবেল।
বাংলাদেশ শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, শব্দের সর্বোচ্চ ঘনমাত্রার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন এলাকাকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা ও শিল্প এলাকা। এই বিধিমালায় বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকায় রাত নয়টা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় রাতে ৬০ ও দিনে ৭০ ডেসিবেলে থাকতে হবে। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এতে। এসব এলাকায় রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। শিল্প এলাকায় এ মাত্রা রাতে ৭০ ও দিনে ৭৫ ডেসিবেল এবং মিশ্র এলাকায় রাতে ৫০ ও দিনে ৬০ ডেসিবেল থাকার কথা বলা হয়েছে।
বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, গত চার বছরের তিন বছরে তাঁরা শহরের পাঁচটি এলাকায় শব্দ মেপেছেন। এতে সব জায়গায় নির্ধারিত শব্দের মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। শহরের রেলগেট, তালাইমারী, সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট ও লক্ষ্মীপুর মোড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। এতে সেখানে বেশি শব্দদূষণ হয়। আর গাড়ি চালানো মানেই হর্ন বাজানো—বিষয়টি চালকদের মাথায় গেঁথে আছে। জনসচেতনতা, চালকদের প্রশিক্ষণ, যথাযথ আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে শব্দ নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে।
জাকির হোসেন পরামর্শ দিয়ে বলেন, শব্দদূষণের প্রভাব শুধু মানুষের ওপর না, প্রতিটি পশুপাখির ওপর পড়ে। গাছ শব্দের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যথেষ্ট কার্যকর। আমের শহর রাজশাহীতে আম ও জামজাতীয় ফলের গাছ এবং নিম ও শজনেজাতীয় উপকারী গাছ লাগানো যেতে পারে। এগুলো বড় হলে শব্দ ও বায়ুদূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
সোমবার সকাল ১০টায় রাজশাহী নগরের তালাইমারী মোড়ে দেখা যায়, একটি যাত্রীবাহী বাস থামামাত্রই উচ্চ শব্দে হর্ন বাজাল। ৫ থেকে ৭ মিনিট ইঞ্জিন চালু অবস্থায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাকালে আরও দুবার হর্ন দিল। তারপর গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সময় আবারও হর্ন বাজল। তালাইমারী এলাকার এ রকম গাড়ির অপ্রয়োজনীয় হর্ন শহরজুড়ে বাজানো হয়।
নগরের তালাইমারী মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির চালক মোসলেম আলীকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কেন দাঁড়িয়ে রাখা অবস্থায় উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো হচ্ছে। জবাবে তিনি বললেন, যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি হর্ন বাজাচ্ছেন। পরে বললেন, গাড়ি চালাতে গিয়ে এটি অভ্যাস হয়ে গেছে।
তালাইমারী মোড়ের পাশেই রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকার গাড়ির শব্দ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও প্রবেশ করে। এখানকার শিক্ষার্থী রিফাত হোসেন বলেন, ‘হর্ন বাজানোতে চালকেরা মজা পান। শুধু বাস বা অটোরিকশা না, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য গাড়িও অযথা হর্ন বাজায়। এগুলো নিয়ন্ত্রণে কোনো অভিযান নেই, জনসচেতনতাও নেই।’
শুধু এই এলাকাগুলোই নয়, নগরের ভদ্রা মোড়ে একরকম প্রতিযোগিতা করে হর্ন বাজানো হয়। ওই মোড়ে সব সময় পাঁচ-সাতটি বাস দাঁড়িয়ে থাকে। এ ছাড়া নগরের ঢাকা বাসস্টেশন এলাকা, রেলগেট ও আমচত্বর এলাকায় ট্রাকের হর্ন বাজানো হয়।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাজশাহী জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ২০২২ সাল থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২৮টি অভিযান পরিচালনা করেছে। নগরের বিভিন্ন এলাকায় এসব অভিযানে প্রায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি ১২৪টি হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চালক, ইমাম ও গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে তারা বেশকিছু কর্মশালা করেছে।
এ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, রাজশাহী শহর অনেক ছোট। কিন্তু এখানে অনেক পরিবহন। শহরে নিবন্ধের বাইরে অসংখ্য অটোরিকশা রয়েছে। শহরের মধ্যে একাধিক বাস টার্মিনালও রয়েছে। যথাযথ ট্রাফিক–ব্যবস্থাও নেই। হাতের ইশারায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হয় শহরে। সবকিছু মিলে শব্দদূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন দূষণ রোধে। এখানে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব পক্ষের সমন্বয় ও ভূমিকা প্রয়োজন। জনসচেতনতা ও সবার সহযোগিতা ছাড়া শব্দদূষণ কমানো যাবে না।
ক্রমাগত শব্দদূষণ বাড়ার প্রভাব পড়ছে মানুষের স্বাস্থ্যে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মুখপাত্র ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ শংকর কে বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, অতিমাত্রায় শব্দ শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতি করে থাকে। শিশু ও বয়স্কদের জন্য এটি বেশি ক্ষতিকর। এর প্রভাবে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা রোগ হয়। এমনও দেখা গেছে, হার্টের সমস্যায় ভোগা রোগী উচ্চ শব্দের কারণে মারা গেছেন। এটি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্যও ক্ষতিকর। এ ছাড়া শব্দদূষণের কারণে মেজাজ খিটখিটে ভাব, অমনোযোগী হওয়া, খাবারে অবসাদসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়।