চারপাশে অসংখ্য গাছগাছালি। কোনো কোনো গাছের বয়স ১০০ পেরিয়েছে। আছে রংবেরঙের নানা প্রজাতির ফুলের গাছও। উঠানে শুকাতে দেওয়া ধান খুঁটে খাওয়ার চেষ্টা করছে দোয়েল, চড়ুই, কাক। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর মাঝেমধ্যে পাখির ডাক ছাড়া কোনো শব্দই নেই। একেবারেই নীরব, নির্জন, নিস্তব্ধ পরিবেশ।
দৃশ্যটি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের। এমনই এক স্থানে ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আসাম-টাইপ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করা কাঠের শতবর্ষী এক দোতলা বাড়ি। এখন থেকে ১০১ বছর আগে, ১৩৩১ বঙ্গাব্দে বাড়িটি তৈরি করেছিলেন জমিদার জয়নারায়ণ দেব চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে এ বাড়ি জয়নারায়ণ দেব চৌধুরীর ছেলে জিতেন্দ্র নারায়ণ দেব চৌধুরী কামাখ্যার নামে ‘কামাখ্যা বাবুর বাড়ি’ আর ‘বাবুর বাড়ি’ হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পায়।
বয়স শত বছর পেরোলেও বাড়িটি এখনো বসবাসের উপযোগী। উত্তরসূরিদের প্রায় সবাই প্রবাসে থাকলেও মাঝেমধ্যে দেশে আসেন। কিছুদিন পূর্বপুরুষদের তৈরি বাড়িতে সময় কাটিয়ে আবার তাঁরা প্রবাসে চলে গেলে যথারীতি বাড়ির দরজা-জানালা আবারও বন্ধ থাকে। এতে ঘরজুড়ে সারাক্ষণ থাকে গুমোট অবস্থা। সুযোগ বুঝে দুয়েকটি কক্ষে বাদুড়ও আবাস গেড়ে নেয়। বিভিন্ন কক্ষের দখল নেয় ইঁদুর, টিকটিকি আর তেলাপোকারাও।
জমিদারবাড়ির ঠিক পাশেই আছে দৃষ্টিনন্দন বিষ্ণুমন্দির। এটিও শতবর্ষী। মন্দিরের ভেতরে-বাইরে ফুল আর লতাপাতার দারুণ সব নকশা আছে। পাশেই প্রণামরত গরুড় (পাখিদের রাজা এবং দেবতা নারায়ণের বাহন) স্তম্ভ। আশপাশেই শত বছর আগে তৈরি করা অতিথিশালা, ধান রাখার দুটি ভাঁড়ার (গোলাঘর), কাছারিঘর, হেঁশেল, গরু-ভেড়াসহ পশু রাখার ঘর রয়েছে। যাঁরা এখন বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে আছেন, তাঁরা অতিথিশালা সংস্কার করে সেখানেই থাকছেন। এ ছাড়া তাঁদের উদ্যোগেই ১০০ বছরের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এখনো প্রাত্যহিক জলদান এবং প্রতি বৃহস্পতিবার মন্দিরে বিষ্ণুর পূজা-অর্চনা হয়। দক্ষিণে রয়েছে শিবসাগর দিঘি।
জমিদারবাড়ির তত্ত্বাবধানে থাকা শুধাংশু দত্ত (৭০) বলেন, জমিদারবাড়ির উত্তরাধিকারদের প্রায় সবাই দেশের বাইরে থাকেন। দেশে এলে তাঁরা বাড়িতে কিছুদিন সময় কাটান। অন্য সময় জমিদারদের মূল ঘরটি তালাবদ্ধই থাকে। তবে ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ি দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে এখন মানুষেরা ছুটে আসেন।
এক দুপুরে জমিদারবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গাছগাছালিতে ঘেরা ৪০০ শতকের জায়গার এক কোণে বাড়ির অবস্থান। অনেকটা জনশূন্য স্থানে মূল জমিদারবাড়িটি তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। এ বাড়িলাগোয়া আরও কিছু ঘর অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। তুলনামূলকভাবে জনমানবহীন থাকাতেই পুরো এলাকার পরিবেশ অনেকটা রহস্যময় ও ভুতুড়ে লাগে।
জমিদারবাড়ির ভেতরে থাকা প্রতিটি ঘরেই প্রাচীনত্বের ছাপ সুস্পষ্ট। মূল জমিদারবাড়ির টিনের ছাদের সামনের অংশের তিন দিকে টিনের তৈরি তিনটি ময়ূর খচিত আছে। বাড়ির দোতলায় চারপাশজুড়ে আছে সরু বারান্দা। বহু পুরোনো হওয়ায় বারান্দার কাঠের পাটাতন কিছুটা নড়বড়ে হয়ে গেলেও এখনো অক্ষত আছে। বারান্দার লোহার রেলিংয়ের নকশাগুলো আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। মূলত ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সিলেটে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হলে এ অঞ্চলে আসাম–টাইপ স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত বাড়িগুলো জনপ্রিয় হয়। এ ধারাবাহিকতায় নির্মিত হয় জমিদারবাড়িটি।
জমিদারদের কাঠের আসাম–টাইপ স্থাপত্যরীতিতে দোতলা বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, ঘরটিতে ছয়টি কক্ষ রয়েছে। টিনের চালে সাবেকি নকশা। টিন, কাঠ আর ব্যাটনে নির্মিত ঘরের ভেতরে বিভিন্ন কক্ষে খাট, টেবিল, চেয়ারসহ পুরোনো সব আসবাব আছে। রয়েছে একালের কিছু আসবাবও। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যেতে হয়। ঘরের দেয়ালে কোথাও কোথাও ঝুলছে জমিদার পরিবারের বিভিন্নজনের আলোকচিত্র। কোথাও আবার দেব–দেবীর ছবি আছে। এখানে-সেখানে পড়ে আছে পিতল-তামার কিছু বাসন আর শোপিস।
ফেঞ্চুগঞ্জের বাসিন্দা ও ঐতিহ্য-সংগ্রাহক শিশির কুমার নাথ বলেন, ‘আমাদের জানামতে, জমিদারবাড়িটি এখানকার প্রথম কাঠের দোতলা বাড়ি। বাড়িটি সিলেটি স্থাপত্য–ঐতিহ্যও বহন করছে। শতাব্দীপ্রাচীন হওয়াতে বর্তমানে বাড়িটির কোনো কোনো নিদর্শন বিনষ্ট হতে শুরু করেছে। ঐতিহ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মূল কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণ করা উচিত। স্থাপত্য-ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে বাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকুক সগর্বে, গল্প বলুক ইতিহাসের অক্ষরে।’