
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। সকালবেলা মায়ের হাতে খাবার খেয়ে আন্দোলনে যান দীপ্ত। মাকে বলেছিলেন, বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেই দুপুরের আগেই বাড়িতে ফিরবেন, কিন্তু দীপ্ত আর ফিরে আসেননি। মা-বাবার কাছে এসেছিল দীপ্তর লাশ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এই দিনে মাদারীপুরে প্রথম শহীদ হন দীপ্ত দে। মারা যাওয়ার এক বছর কেটে গেলেও তাঁর পরিবার এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দীপ্তর মা-বাবা ছেলের ফ্রেমবন্দী ছবি দেখে রোজই চোখের জল ফেলেন।
দীপ্তর মা মনিকা দে এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না তাঁর ছেলে দীপ্ত আর পৃথিবীতে নেই। প্রতিটি ক্ষণে তিনি দীপ্তর স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। ছেলের সব স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভাসে। স্মৃতি মনে করে ছেলের সঙ্গে একা একা কথা বলেন মনিকা দে। বাবা স্বপন কুমার দের অবসর সময় কাটে দীপ্তর ছবি দেখে।
দীপ্তর পৈতৃক বাড়ি ভোলায়। তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মাদারীপুর শহরে। বাবা স্বপন কুমার দে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাদারীপুর কার্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তা। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন শহরের আমিরাবাদ এলাকায় ভাড়া বাসায় ছিলেন। দীপ্তর মৃত্যুর পর তাঁরা শহরের জেলা পরিষদ-সংলগ্ন হারুন সড়কে একটি বাসায় চলে গেছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে দীপ্ত ছিলেন বড়। তাঁর ছোট ভাই হেমন্ত দে (১৯) মেডিকেল ভর্তি কোচিং করছেন ঢাকায়। দীপ্ত মাদারীপুর সরকারি কলেজে প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মাদারীপুর সরকারি কলেজের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।
শুক্রবার সকালে দীপ্তদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, মা-বাবা দুজনই ঘরে মনমরা হয়ে বসে আছেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে বাসায় নেই কোনো আয়োজন। দীপ্তর শয্যাকক্ষে তাঁর ব্যবহৃত বইখাতা, চেয়ার-টেবিল আর বিছানায় হাত রেখে বারবার ছেলের কথাই স্মরণ করছেন মা মনিকা দে।
মনিকা দে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর এই দিনে সকালটা কত সুন্দর ছিল। ছেলে আমার হাতে মাখা ভাত খেয়ে বের হইল। আর ফিরে এল না। আমার ছেলে বাঁচার জন্য চিৎকার করেছে, কেউ ওরে বাঁচাইতে আসে নাই। ছেলেডা আমার অনেক কষ্ট পাইছে। আমার চোখে এখনো ভাসে, দীপ্ত ঘরে থাকলে সব সময়ই বলত, “মা, প্লিজ, তুমি ভাত মেখে খাওয়াইয়া দাও। মা, এক কাপ চা করে দাও”, এ কথা এখন আর কেউ বলে না। ওরা আমার ছেলেকে বাঁচতে দিল না।’
দেশের জন্য দীপ্ত প্রাণ দিয়েছেন জানিয়ে তাঁর বাবা স্বপন কুমার দে বলেন, ‘মাদারীপুরে প্রথম শহীদ হয়েছে আমার ছেলে। এটি ভাবতেই আমার বুক গর্বে ভরে যায়। বাইরে গেলে যখন দীপ্ত নাম উচ্চারণ করে, তার সাহসিকতার প্রশংসা করে, তখন মনে হয়, আমার ছেলের জীবন উৎসর্গ করাটা সার্থক হয়েছে। কিন্তু যখন বাসায় ফিরে আসি, তখন চারদিকে শুধু দীপ্তকে খুঁজে বেড়াই। ওর কথাই শুধু মনে পড়ে।’
ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দেখে মরতে চান স্বপন কুমার দে। তিনি বলেন, ‘যখন ছেলেটা মারা যায়, তখন ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে লাশ সৎকার করে ফেলতে হয়েছে। আমরা নিজে থেকে মামলাও করিনি। তবে শুনেছি, একটি মামলা কেউ করেছে। যারা আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী, তাদের বিচার শুনেছি সরকার করবে। যদি সেটা করতে পারে, তাহলেই দীপ্তর আত্মা শান্তি পাবে।’
ছেলের মৃত্যুর পর কারও সহযোগিতা পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে দীপ্তর বাবা বলেন, ‘সরকারের কাছে অনুদান চাই না। এরপরও সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। জুলাই ফাউন্ডেশনের টাকা এখনো আমাদের দেওয়া হয়নি। শুনেছি, ভোলা থেকে দেবে। এসব অনুদান পাওয়া না–পাওয়া নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। সরকারের কাছে একটাই চাওয়া, যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মারা গেছে, তাদের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, আহতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জেলার প্রথম শহীদ দীপ্তর স্মরণে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি না করায় ক্ষুব্ধ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক নেয়ামত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীপ্ত আমাদের কাছে একটি শক্তির নাম। মাদারীপুরের মানুষের হৃদয়ে দীপ্ত চিরকাল বেঁচে থাকবে। দীপ্তর মৃত্যুর পরই জেলায় আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নেয়। অথচ দীপ্তর নামে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলক এখনো নির্মাণ করা হয়নি। আমরা খুবই আশাহত।’
গত বছরের ১৮ জুলাই সকালে দলে দলে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শহরের ডিসি ব্রিজ এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজনের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয় এবং লাঠিপেটা করা হয়। তখন দীপ্তসহ অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী আহত অবস্থায় শকুনি লেকের পানিতে পড়ে যান। পানিতে পড়ে দীপ্ত মারা যান।