ঈদুল আজহার লম্বা ছুটিতে অন্তত আট লাখ পর্যটকের সমাগম হবে বলে আশা করছেন কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকেরা। তখন জমে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্যও। হোটেলমালিকদের ভাষ্য, ঈদের দ্বিতীয় দিন ৮ জুন থেকে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। ৯ জুন থেকে হোটেল, রিসোর্ট ও গেস্টহাউসগুলো ভরা থাকবে, যে ধারা থাকবে ১৯ জুন পর্যন্ত।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গত ঈদুল ফিতরের ছুটিতে কক্সবাজারে ১২ লাখ পর্যটক এসেছিলেন। তখন হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান, শুঁটকি ও সামুদ্রিক মাছসহ ১৩টি খাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে। এবারের ঈদুল আজহার ছুটিতে আট লাখ পর্যটকের বিপরীতে ৭০০ কোটি টাকার মতো ব্যবসা হতে পারে।
হোটেল কক্ষ আগাম বুকিং
কলাতলী হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, বুধবার (৪ জুন) সন্ধ্যা পর্যন্ত হোটেলগুলোতে ৭০০–৮০০ পর্যটক ছিলেন। বৃহস্পতিবার তাঁদের অনেকেই কক্সবাজার ছাড়লে হোটেলগুলো পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে যাবে। তবে ৯ থেকে ১৯ জুন সৈকত হয়ে উঠবে লোকে লোকারণ্য। এখন পর্যন্ত ৯ থেকে ১১ জুনের বুকিং বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ৭৭ শতাংশ কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে গেছে। বাকি ২৩ শতাংশ কক্ষও দ্রুত বুকিং হয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
হোটেলমালিকেরা জানান, তারকা হোটেল সিগাল, সায়মান, মারমেইড, ওশান প্যারাডাইস, বে-ওয়াচ, জলতরঙ্গ, হোটেল কল্লোল, রয়্যাল টিউলিপসহ অন্তত ২৫টি তারকা মানের হোটেল-রিসোর্টে ৯০ শতাংশ কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে গেছে। সাধারণ মানের পাঁচ শতাধিক হোটেলে বুকিং হয়েছে ৪০ শতাংশ কক্ষে।
মুকিম খান বলেন, ৭ জুন থেকে ছুটি শুরু হলেও পর্যটকের ঢল নামবে ৯ জুন থেকে। ওই দিন অন্তত ১ লাখ পর্যটক আসবেন। ১০ ও ১১ জুন দিনে দেড় লাখ করে ৩ লাখ পর্যটক আসবেন। এরপর ১২ থেকে ১৯ জুন প্রতিদিন গড়ে ৬০ হাজার করে ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি পর্যটক আসবেন। সব মিলিয়ে ১০ দিনে আট লাখের বেশি পর্যটক কক্সবাজারে ভিড় করবেন। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও এ সংখ্যা কমবে না। কারণ, উত্তাল সমুদ্র অনেক পর্যটকের কাছে বাড়তি আকর্ষণ।
জুনের শুরুতে ভারী বৃষ্টিপাত এবং সমুদ্র উত্তাল থাকায় কয়েক দিন সৈকতে গোসলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।
হোটেলমালিকদের ভাষ্য, এবারের ঈদের ছুটিতে কক্ষভাড়ায় তেমন ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। কিছু হোটেল-রিসোর্ট, গেস্টহাউস ও কটেজে বিশেষ বিবেচনায় ১০–২০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় মিলছে। রোজার ঈদের ছুটিতেও ছাড় ছিল না। তবে অফসিজনে এই ছাড় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হয়। কক্সবাজারের পাঁচ শতাধিক হোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজে দৈনিক ধারণক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার।
ফাঁকা সৈকত
আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় কলাতলী পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, এক কিলোমিটার সৈকতে কয়েক শ নারী-পুরুষ ভিড় করেছেন। তাঁরা চেয়ার-ছাতায় বসে উত্তাল সমুদ্রের রূপ উপভোগ করছেন। সুগন্ধা পয়েন্টেও ছিল কিছুটা ভিড়। কেউ কেউ সাগরে নেমে গোসল করছেন। তাঁদের ওপর নজর রাখছেন বেসরকারি লাইফগার্ড প্রতিষ্ঠান ‘সি-সেফ’-এর কর্মীরা।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, সৈকত এখনো ফাঁকা। কলাতলী থেকে সুগন্ধা হয়ে লাবণী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সৈকতে হাজারখানেক পর্যটক আছেন। তাঁদের নিরাপত্তায় ২৬ জন লাইফগার্ড প্রস্তুত রয়েছেন। আছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের বিচকর্মীরাও।
কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাভেদ ইকবাল বলেন, ঈদের ছুটিতে শহরের ছয় শতাধিক রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা হয়েছে। ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে আবার খোলা হবে। কোনো রেস্তোরাঁ যেন ভেজাল খাবার না দেয় কিংবা অতিরিক্ত দাম না নেয়, সে জন্য নজরদারি করা হচ্ছে।
রঙিন নৌকার টান
সমুদ্রসৈকত ছাড়াও অনেক পর্যটক ছুটে যান কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে। পূর্ব পাশে পাহাড় আর পশ্চিমে বিশাল সমুদ্রসৈকত নিয়ে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। মেরিন ড্রাইভে যেতে যেতে দেখা মেলে দরিয়ানগরের গুহা, হিমছড়ির ইকো ট্যুরিজম, ইনানী ও পাটোয়ারটেক সৈকত। এসব কেন্দ্র নতুন সাজে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তবে পর্যটকদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ মেরিন ড্রাইভের শেষ প্রান্ত টেকনাফ সৈকত। সেখানে রঙিন পাঁচ শতাধিক নৌকা সারি করে দাঁড়িয়ে থাকে। এসব নৌকায় উঠে কিংবা পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন পর্যটকেরা।
টেকনাফ ঘুরে অনেকে যান ‘নেটং’ পাহাড়ে। পাহাড়চূড়া থেকে দেখা যায় আন্তর্জাতিক নাফ নদী, জালিয়ারদিয়া দ্বীপ ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। কয়েক মাস ধরে এ রাজ্যটি নিয়ন্ত্রণ করছে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গিয়াস উদ্দিন বলেন, উত্তাল সমুদ্রে গোসলের সময় সতর্কতা ছাড়া টেকনাফে যেতে নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে সন্ধ্যার পর মেরিন ড্রাইভের পশ্চিম পাশের ঝাউবাগান ও পূর্ব পাশের বাহারছড়া এলাকার পাহাড়-জঙ্গলে যাওয়া নিরাপদ নয়। সেখানে অপহরণচক্র সক্রিয়।
ওসির ভাষ্য, টেকনাফ সৈকতে দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য এখনো পর্যাপ্ত ডুবুরি বা লাইফগার্ড নেই।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, ঈদের ছুটিতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। পর্যটকেরা চাইলে জেলা প্রশাসনের তৈরি মুঠোফোন অ্যাপ ‘ভ্রমণিকা’ ঘুরে দেখে হোটেল কক্ষ, যানবাহন, গণপরিবহনের টিকিটসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য জানতে পারবেন।