অমিত হাসান ও মানিক মিয়া
অমিত হাসান ও মানিক মিয়া

কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়া দুই তরুণকে সাগরপথে থাইল্যান্ডে পাচারের চেষ্টা

অমিত হাসান ও মানিক মিয়া। দুই তরুণের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ সদরে। মুন্সিগঞ্জেই তাঁদের পরিচয় হয় কক্সবাজারের এক বাসিন্দার সঙ্গে। তাঁরই আমন্ত্রণে দুজন কক্সবাজারে বেড়াতে যান। সেখানে ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে টেকনাফে বেড়াতে নেওয়ার কথা বলে অমিত ও মানিককে মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন কক্সবাজারের ওই বাসিন্দা। এরপর পাচারকারীরা সাগরপথে থাইল্যান্ডে পাচারের জন্য দুজনকে টেকনাফের গহিন পাহাড়ের ভেতরের একটি আস্তানায় আটকে রাখেন। ২০ দিন পর র‍্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে তাঁরা উদ্ধার হয়েছেন।

টেকনাফের বাহারছড়া কচ্ছপিয়ার গহিন পাহাড় থেকে গতকাল রোববার উদ্ধার করা হয় অমিত হাসান ও মানিক মিয়াকে। কেবল এই দুজন নয়, পাহাড়ের ওই আস্তানা থেকে নারী-শিশুসহ আরও ৮২ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের সাগরপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারের জন্য আস্তানাটিতে জড়ো করা হয়েছিল বলে জানান র‍্যাব-বিজিবির কর্মকর্তারা। অভিযানে অস্ত্র-গুলিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মানব পাচারকারীদের আস্তানা থেকে ৮৪ জনকে উদ্ধারের বিষয়ে আজ সোমবার দুপুরে টেকনাফ ২ বিজিবির সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান ও র‍্যাব-১৫–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান অভিযানের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

বিজিবি-র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানান, উদ্ধার হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে অমিত হাসান ও মানিক মিয়াকে জোর করে পাচারকারীদের ওই আস্তানায় নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়। অন্যদের আস্তানাটিতে নিয়ে আসা হয় নানা প্রলোভনে। এর মধ্যে অনেককে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে উন্নত জীবনযাপন ও চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়েছে। কয়েকজন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। উদ্ধার করা ৮৪ জনের ৬৬ জনই রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা।

বিজিবি কার্যালয়ে অমিত হাসান ও মানিক মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। দুজন বলেন, মো. নূর নামের কক্সবাজারের এক বাসিন্দা কিছুদিন তাঁদের এলাকায় ছিলেন। নূরের আমন্ত্রণে ২ সেপ্টেম্বর দুজন কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন। ওই দিন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার মরিচ্যা এলাকায় নূরের বাড়িতে যান তাঁরা। এরপর তাঁদের টেকনাফে বেড়াতে নেওয়ার কথা বলে একটি অটোরিকশায় তুলে মানব পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন নূর।

অমিত হাসান ও মানিক মিয়া বলেন, সাগরপথে থাইল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে পাহাড়ের আস্তানাটিতে তাঁদের আটকে রাখেন পাচারকারীরা। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে চাইলেই মারধর করা হতো।

টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ওই আস্তানায় অভিযান শুরুর পর পাচারকারীরা যৌথ বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে তিনটি গুলি ছোড়েন। এ সময় কিছু ভুক্তভোগীকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পালাতে চেয়েছিলেন তাঁরা। তবে পুরো পাহাড়টি ঘিরে ফেলে কৌশলে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়। তিনি আরও বলেন, প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে এই অভিযান চালানো হয়। এ সময় তিনজনকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অভিযানে আটক তিনজন হলেন টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া এলাকার সালামত উল্লাহর ছেলে আবদুল্লাহ (২১); রাজরছড়ার আবুল হোসেনের ছেলে সাইফুল ইসলাম (২০), একই এলাকার মো. ফিরোজের ছেলে মো. ইব্রাহিম (২০)। তাঁদের কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, একটি একনলা বন্দুক, একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি দেশি রামদা, একটি চাকু ও তিনটি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা হয়েছে।

মুঠোফোনে বিয়ের পর সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা

অভিযানে উদ্ধার হওয়া এক তরুণীর সঙ্গে কথা হয় টেকনাফ ২ বিজিবির সদর দপ্তরে। মেহেদি দিয়ে নকশা আঁকা তাঁর হাতে। তিনি জানান, ১৫ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ায় থাকা এক রোহিঙ্গা তরুণের সঙ্গে মুঠোফোনে তাঁর বিয়ে হয়েছে। এরপর ‘স্বামী’ তাঁকে সাগরপথে মালয়েশিয়া চলে যাওয়ার জন্য কিছু লোকের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে আশ্রয়শিবির থেকে বের হয়ে ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তাঁকে গহিন পাহাড়ের আস্তানাটিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তরুণী আরও বলেন, সাগরপথে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর কাছে কোনো টাকা দাবি করা হয়নি। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর তাঁর স্বামীর কিছু টাকা দেওয়ার কথা ছিল।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে এ পর্যন্ত টেকনাফে ৬৫ মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া উদ্ধার করা হয়েছে ১৬১ জনকে। শীত মৌসুমে মানব পাচারের ঘটনা বেশি ঘটে।