কাঁচিকাটার মাঝপদ্মায় বালুমহাল ঘোষণা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করছে জেলা প্রশাসন। ওই স্থানে বালু উত্তোলন করা হলে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের কাঁচিকাটা এলাকায়
কাঁচিকাটার মাঝপদ্মায় বালুমহাল ঘোষণা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করছে জেলা প্রশাসন। ওই স্থানে বালু উত্তোলন করা হলে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। সম্প্রতি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের কাঁচিকাটা এলাকায়

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ

পদ্মায় বালুমহাল ইজারা দেওয়ার উদ্যোগ প্রশাসনের, এলাকাবাসীর শঙ্কা–উদ্বেগ

গত বছরও একই এলাকায় বালুমহাল ইজারা দিয়েছিল প্রশাসন। স্থানীয় লোকজনের বাধা ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় তা বন্ধ করা হয়।

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার কাঁচিকাটা এলাকায় পদ্মা নদীতে বালুমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, ওই এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে নদীর রূপ (হাইড্রোমরফোলজি) ও গতিপথের পরিবর্তন হয়ে প্রবাহ তীরের দিকে আসতে পারে।

গত বছরের মার্চে জেলা প্রশাসন কাঁচিকাটা ইউনিয়নের বাঘাইয়া মৌজায় ১৫ একর নদীতে বালুমহাল ঘোষণা করে ইজারা দিয়েছিল। পরে স্থানীয় লোকজনের বাধা ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে তা বন্ধ করতে বাধ্য হয় জেলা প্রশাসন। এক বছর পর আবার একই এলাকার আরেকটি মৌজায় বালুমহাল ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার খবরে স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে ভয়াবহ ভাঙনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের এই প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে পদ্মার তীরবর্তী এলাকার মানুষ ৩ মে মানববন্ধন, নদীর তীরে অবস্থানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন।

জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বালুমহাল ঘোষণার জন্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, বিশেষ করে পাউবো, পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগ থেকে প্রতিবেদন নেওয়া হয়েছে। সব কটি দপ্তরই ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। কেউ নেতিবাচক কোনো মন্তব্য করেনি। তাই বালুমহাল ঘোষণার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই সব প্রতিবেদন কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়েছে। সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।’

এই এলাকা ভাঙনকবলিত। নদীতে বালু জমে চর হয়। চর অপসারণ করলে কখনো ভাঙন কমে, আবার কখনো ভাঙন বৃদ্ধি পায়।
তারেক হাসান, নির্বাহী প্রকৌশলী, শরীয়তপুর পাউবো

কাঁচিকাটা এলাকার বাসিন্দা দাদন মিয়ার বয়স ৪৮ বছর। এ পর্যন্ত ৪ দফা ভাঙনে তাঁদের ১০ একর ফসলি জমি পদ্মায় বিলীন হয়েছে। অবশিষ্ট তিন একর জমিও পদ্মার তীরে। তিনি বলেন, কাঁচিকাটার চারদিক দিয়ে নদী। পদ্মা ও মেঘনার আগ্রাসন আছে। তাঁর মতো হাজারো মানুষ নদীতে সব হারিয়ে নিঃস্ব। বর্ষা এলেই তাঁরা দুশ্চিন্তায় থাকেন, কখন আবার ভাঙনের মুখে পড়তে হয়। কাঁচিকাটায় বালুমহাল ইজারা দেওয়া হলে ভাঙন বৃদ্ধি পাবে। 

কাঁচিকাটা ইউনিয়নের চারদিকে পদ্মা নদী। এর একদিকে মুন্সিগঞ্জ, আরেক দিকে চাঁদপুরের সীমানা। নৌপথ ব্যবহার করে ওই ইউনিয়নের মানুষদের যাতায়াত করতে হয়। পদ্মা নদীর মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় চরটি ভাঙনপ্রবণ। বর্তমানে ইউনিয়নটির কাঁচিকাটা, দক্ষিণ মাথাভাঙা, নাককাটা, বোরকাঠি, মান্দারতলী ও মরিছাকান্দি গ্রাম ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। ওই ছয় গ্রামের অন্তত দুই হাজার পরিবার ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

ইউনিয়নের ৭৭ নম্বর কাঁচিকাটা মৌজায় ২২ দশমিক ৬৩ একর নদীতে বালুমহাল ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিন গত ২৭ মার্চ বালুমহাল ইজারার দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য তালিকাভুক্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। একই দিন তিনি বালুমহাল ঘোষণার অনুমতি চেয়ে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি দেন।

বালুমহাল ঘোষণা দিয়ে বালু উত্তোলন করা হলে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের আশঙ্কা করছে পাউবো। তখন নদীতে ভাঙন দেখা দিতে পারে। কাঁঁচিকাটা এলাকা থেকে সম্প্রতি তোলা

বালুমহাল ঘোষণার জন্য জেলা প্রশাসন পাউবোর কাছ থেকে যে মতামত নিয়েছে, তাতে পাউবো উল্লেখ করেছে, কাঁচিকাটার যে স্থানে বালুমহাল ঘোষণার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, তার অবস্থান পদ্মা–মেঘনার মিলনস্থল থেকে সাত কিলোমিটার উজানের একটি ডুবোচর। তার ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে পাউবোর বাস্তবায়ন করা ডান তীর রক্ষা প্রকল্প, ১০ কিলোমিটার উজানে জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলায় পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ আছে। ওই স্থান থেকে ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরে নদীর বাঁ তীরের দিকে কাঁচিকাটা মুন্সিরবাজার এলাকায় ভাঙন আছে। ভাঙন রোধে তীর সংরক্ষণ কাজের একটি প্রকল্প প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান বলেন, এই এলাকা ভাঙনকবলিত। নদীতে বালু জমে চর হয়। চর অপসারণ করলে কখনো ভাঙন কমে, আবার কখনো ভাঙন বৃদ্ধি পায়। বালু উত্তোলন করতে হলে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বালু কাটতে হবে। তা না হলে নদীর গতিপথের পরিবর্তন হতে পারে।

জেলা প্রশাসন ও পাউবো জানায়,  জাজিরার নাওডোবা থেকে ভেদরগঞ্জের চরসেনসাস দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদীর দুই তীরে জেলার ৩টি উপজেলার ২১টি ইউনিয়ন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়নগুলোর বিভিন্ন স্থানে ভাঙন আছে। গত ১০ বছরে এসব এলাকায় পদ্মার ভাঙনে অন্তত ২৫ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। ভাঙন রোধে গত পাঁচ বছরে পাউবো এলাকাগুলোয় অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।