
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের নতুন কৌশল হিসেবে শামুক নিধন ও পাচার শুরু করেছে একটি অসাধু চক্র। বনসংলগ্ন নদী ও খাল থেকে প্রতিদিন ট্রলার ও নৌকায় ভরে শামুক আহরণ করা হচ্ছে। পরে এসব শামুক ট্রাকে সড়কপথে কিংবা ট্রলারে নদীপথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, অর্থের লোভ দেখিয়ে প্রান্তিক জেলেদের এ কাজে জড়ানো হচ্ছে। প্রতিদিন কয়েক শ মণ শামুক সংগ্রহ করা হচ্ছে।
২১ অক্টোবর সকালে সুন্দরবনসংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীর তীর থেকে ৬৫০ কেজি শামুক উদ্ধার করা হয় বলে জানান বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা মো. নাসির উদ্দীন।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন–১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) ও জলজ সম্পদ সংরক্ষণ আইন–১৯৫০ অনুসারে, নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয় থেকে শামুক বা ঝিনুক আহরণ ও পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং এ কাজ দণ্ডনীয় অপরাধ।
বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শামুক ও ঝিনুক নদীর তলদেশের মাটি ও পানির গুণগত মান বজায় রাখে। এগুলো নদীর প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসেবে কাজ করে, দূষণ কমায়, মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং মাছ ও কাঁকড়ার খাদ্যচক্র ধরে রাখে। ব্যাপক নিধন হলে নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়বে।
এর আগে সুন্দরবনে একাধিকবার শামুক পাচারের ঘটনা ধরা পড়েছে। ১৩ অক্টোবর থেকে বন বিভাগ কয়রা উপজেলায় মাইকিং করে সতর্ক করে বলছে, শামুক আহরণ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুন্দরবন-সংলগ্ন উপকূলীয় খুলনার কয়রা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, বন বিভাগের মাইকিং ও অভিযানের পরও শামুক আহরণ বন্ধ হচ্ছে না। বনাঞ্চল ঘেঁষে থাকা পশুরতলা খাল, কৈখালীর মাদার নদী, জয়াখালী খাল, শাকবাড়িয়া নদী, কয়রা নদী ও কপোতাক্ষ নদ থেকে প্রতিদিনই অবৈধভাবে শামুক সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সম্প্রতি কয়রার কাটকাটা এলাকায় সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে গিয়ে দুই শামুক আহরণকারীর সঙ্গে দেখা হয়। তাদের একজন বলেন, তাঁরা সরকারি গুচ্ছগ্রামে থাকেন। কাজকর্ম নেই। এক মাস ধরে নদী থেকে শামুক তুলে বিক্রি করছেন। এ আয় দিয়েই সংসার চলে। শামুক আহরণ যে আইনতভাবে নিষিদ্ধ, সে বিষয়ে তাঁর জানা নেই।
আরেকজন বলেন, নদী থেকে তোলা শামুক কিনে নেন বাইরের কিছু লোক। বিভিন্ন স্থান থেকে শামুক সংগ্রহ করে তাঁরা কয়রার আমাদী ব্রিজের পাশে স্তূপ করে রাখেন। পরে সেখান থেকে ট্রাকে করে শামুক অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
তাঁদের কথার সূত্র ধরে কয়রার আমাদী ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বস্তাভর্তি শামুকের স্তূপ। চারপাশে পচা দুর্গন্ধে টেকা দায়। পাশের কপোতাক্ষ নদে তখনো নারী-পুরুষ ব্যস্ত শামুক তুলতে। রেশমা বেগম নামের এক নারী বলেন, ‘গাঙে শামুক কুড়িয়ে দিনে এক শ কেজির মতো পাই। প্রতি কেজি পাঁচ টাকায় বিক্রি করি।’
কয়রার কপোতাক্ষ নদের তীরবর্তী গোবরা গ্রামের শামিম হোসেন বলেন, জেগে ওঠা বালুচর থেকে দিন–রাত শামুক–ঝিনুক সংগ্রহ করা হয়। ট্রলারে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু ও শামুক একসঙ্গে ওঠানো হয়। পরে পানির স্রোতে বালু ধুয়ে ফেলে শুধু শামুক রাখা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বাধা দিলে আহরণকারীরা হুমকি দেন।
কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, শামুক–ঝিনুক পানি পরিশুদ্ধ করে। মাছ ও কাঁকড়াসহ নানা জলজ প্রাণীর খাবার হিসেবে কাজ করে। নির্বিচার নিধন চললে খাদ্যচক্র ভেঙে নদী ও খাল উজাড় হয়ে যাবে। তাই দ্রুত এটা বন্ধ করা প্রয়োজন।
উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, শামুক কেবল পরিবেশ নয়, স্থানীয় অর্থনীতিরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নিধন চলতে থাকলে উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর পেছনের ব্যবসায়ী ও অর্থদাতাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জেলেদের সচেতন করা এবং বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা জরুরি।
বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন বলেন, বন বিভাগের স্মার্ট টহল টিমসহ কয়েকটি দল নিয়মিত টহল দিচ্ছে, অবৈধ মালামাল জব্দ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বিশেষ অভিযানে বিপুল পরিমাণ শামুক উদ্ধার করে নদীতে অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে শুধু বনাঞ্চলের ভেতর নয়, পাশের লোকালয়েও পাচারকারীরা সক্রিয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবস্থা না নিলে অবৈধ কার্যক্রম ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।