
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় ২৯ একর জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক রেলস্টেশন। ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০১ কিলোমিটারের দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথের সঙ্গে দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশনও উদ্বোধন করেন। কিন্তু উদ্বোধনের প্রায় ১ বছর ৭ মাস পার হলেও স্টেশনে যাত্রীসেবার অনেক সুবিধাই চালু হয়নি। অবকাঠামো তৈরি হলেও সেসব পড়ে থাকায় চুরি হচ্ছে বিদ্যুতের তার, বাল্বসহ মূল্যবান জিনিস। নির্মিত অবকাঠামো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারে দেরির কারণে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে।
রেলস্টেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি), চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি), বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড দুই ভাগে এই কাজ করছে। এটি সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মধ্যে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট আয়তনের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ছয়তলা রেলস্টেশন নির্মাণে খরচ হয়েছে ২৩৬ কোটি টাকা। তবে মূল প্রকল্পে থাকলেও স্টেশনের এক ডজনের বেশি যাত্রী পরিষেবা চালু হয়নি। এসব সুবিধা চালু না হওয়ায় একদিকে যাত্রীরা যেমন হতাশ হচ্ছেন, তেমনি সরকার আয়বঞ্চিত হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ছয়তলা ভবনের নিচতলায় তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী-সেতু, দ্বিতীয় তলায় শপিং মল, শিশুযত্ন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল, চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয় কিছুই চালু হয়নি। ভবনের সম্মুখভাগে তৈরি হয় ঝিনুক আদলের ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করার কথা, কিন্তু প্রবেশপথটি বন্ধ। ফোয়ারাতে পানির বিচ্ছুরণও নেই।
সবকিছু থেকেও নেই, বেহাল দশা
গত ২৮ মে সকালে রেলস্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে পূর্ব পাশের সরু প্ল্যাটফর্ম দিয়ে বেরিয়ে আসছেন। একই পথে ট্রেনে ওঠার জন্য ছুটছেন আরেক দল যাত্রী। তাতে বাড়ছে ভিড়, হুড়োহুড়ি। মালামাল ও শিশুসন্তানদের নিয়ে বের হতে গিয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারী যাত্রীরা।
রেলস্টেশনের টিকিট কালেক্টর শরীফুল ইসলাম বলেন, দুটি ট্রেনের যাত্রীরা যখন ভবনের বাইরে একটি গেট দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করেন এবং বের হন, তখন চেকিং করতে সমস্যা হয়। চেকিং করতে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়াতে হয়।
স্টেশনের প্রবেশপথের পাশে (ভবনের নিচতলায়) একটিমাত্র টয়লেট রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, যাত্রীদের বিশাল লাইন। প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের বসার এবং নামাজের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই খাবারের ব্যবস্থা।
আইকনিক রেলস্টেশনের প্রধান কর্মকর্তা (স্টেশন ম্যানেজার) গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রীসেবার কিছুই চালু হয়নি। রেলস্টেশনের অবকাঠামো নির্মাণ হলেও ২৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ট্রেন পরিচালনার স্বার্থে কয়েকটা কক্ষ তাঁরা ব্যবহার করছেন। এখন দৈনিক দুই জোড়া ট্রেন কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকা চলাচল করলেও যাত্রীসেবার কিছুই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রেলস্টেশনের ক্যারেজ ডিপোর উপসহকারী প্রকৌশলী (রেলযান পরীক্ষক) আব্দুল জলিল বলেন, গত চার মাসে কয়েক দফা চুরির ঘটনা ঘটেছে। অন্তত ছয় হাজার মিটার বিদ্যুতের তার চুরি হয়ে গেছে। যে কারণে সন্ধ্যার পর ট্রেন ওয়াশ এবং ট্রেনের আন্ডার গিয়ার চেকিং করতে সমস্যা হচ্ছে। বিদ্যুতের তার ও বাল্ব চুরি হওয়ায় তিনটি ওয়াশপিট এলাকা অন্ধকারে থাকছে। সর্বশেষ গত রোববার সেপটিক ট্যাংকের আটটি ঢাকনা চুরি হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তারক্ষী না থাকায় প্রায় চুরির ঘটনা ঘটছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের কর্মকর্তা ও আইনকনিক রেলস্টেশনের প্রকৌশলী রাসেল মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইকনিক রেলস্টেশনের সব কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। রেলস্টেশন তৈরির পর এক বছর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের সময়সীমা থাকে। আমরা অল্প জনবল দিয়ে সেই সময় পার করছি। ভবনের কোথাও সমস্যা দেখা দিলে সেটা ঠিক করে দিচ্ছি। ছাদ দিয়ে আগে বৃষ্টির পানি পড়লেও এখন বন্ধ আছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আমরা রেলস্টেশনটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করব।’
ছয়তলা ভবনের নিচতলায় তথ্যকেন্দ্র, মসজিদ, শিশুদের বিনোদনের জায়গা, প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ ও পদচারী-সেতু, দ্বিতীয় তলায় শপিং মল, শিশুযত্ন কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, তৃতীয় তলায় ৩৯ কক্ষবিশিষ্ট তারকা মানের হোটেল, চতুর্থ তলায় রেস্তোরাঁ, শিশুযত্ন কেন্দ্র, কনফারেন্স হল ও কর্মকর্তাদের কার্যালয় কিছুই চালু হয়নি। ভবনের সম্মুখভাগে তৈরি হয় ঝিনুক আদলের ফোয়ারা। যাত্রীরা ঝিনুক ফোয়ারা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করার কথা। প্রবেশপথটিও বন্ধ। ফোয়ারাতে পানির বিচ্ছুরণও নেই।
যাত্রীদের অসন্তোষ
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রেলস্টেশনের বাইরে পার্কিংয়ে কথা হয় ঢাকার মুগদাপাড়ার যাত্রী মনজুর আলমের সঙ্গে। সঙ্গে আছেন স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান। আগের দিন রাত ১১টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা কক্সবাজার এক্সপ্রেসে করে তাঁরা কক্সবাজার রেলস্টেশনে পৌঁছান। অব্যবস্থাপনায় ক্ষুব্ধ মনজুর আলম (৪১) বলেন, দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশনের এমন বেহাল অবস্থায় শতভাগ যাত্রী হতাশ। এক বছর আগে রেলস্টেশনের যে অবস্থা দেখে গেছেন, এখনো তিনি একই অবস্থা দেখলেন। উদ্বোধনের সময় বলা হয়েছিল, রাতের ট্রেনে পর্যটকেরা কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনে পৌঁছে লকারে লাগেজ কিংবা মালামাল রেখে সমুদ্রসৈকত, দর্শনীয় স্থানে ঘুরে ফিরে রাতের ট্রেনে আবার ঢাকায় ফিরতে পারবেন। কিন্তু এসব কিছুই হয়নি।
অসুস্থ মাকে নিয়ে সৈকত ভ্রমণে আসেন ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ী রমজানুল ইসলাম। পায়ের সমস্যার কারণে মা হাঁটতে পারেন না। দুই পা ফুলে গেছে। এক হাতে কাঁধের ব্যাগ, অন্য হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে হেঁটে হেঁটে পার্কিংয়ে আসেন রমজানুল। এরপর শহরের কলাতলীর হোটেলে যাওয়ার জন্য ইজিবাইক খুঁজতে থাকেন। তিনি বলেন, আইকনিক রেলস্টেশনের ভেতরে অসুস্থ এবং প্রতিবন্ধী যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য পদচারী-সেতু, এর সঙ্গে যুক্ত করা পৃথক তিনটি চলন্ত সিঁড়ি নির্মাণ করা হলেও সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। কেন সেসব বন্ধ, তা মাথায় আসে না।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কক্সবাজারের মানুষ আইকনিক রেলস্টেশন পেয়েছে। দৈনিক ১০ জোড়া ট্রেন চলাচলের চাহিদাসম্পন্ন কক্সবাজারে এখন চলছে দুই জোড়া। মালবাহী ট্রেন চালু না হওয়ায় কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ, মাছ, পানসুপারি এবং টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে না। তাতে সরকারও মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চালু হয়নি যাত্রীসেবাও। এ নিয়ে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ।