
চাকরি ফেরতের দাবিতে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের শিখন স্কুলের ছাঁটাই হওয়া শিক্ষকেরা আজ মঙ্গলবার সকাল সাতটা থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের কোর্টবাজার এলাকায় ছয় ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এতে কক্সবাজার ও টেকনাফের মধ্যকার যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে। তীব্র ভোগান্তিতে পড়েন কয়েক হাজার যাত্রী। শিবিরে যেতে পারেনি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার (এনজিও) কর্মকর্তা–কর্মচারীরা।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক জরুরি শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) অধীনে চাকরিচ্যুত শিক্ষকেরা আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন স্কুলে কয়েক বছর ধরে পাঠদান করে আসছিলেন। সম্প্রতি তহবিল–সংকটের কারণ দেখিয়ে ১ হাজার ২৫০ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। ছাঁটাইয়ের শিকার এসব শিক্ষক বাংলাদেশি ও স্থানীয় বাসিন্দা।
চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে চার দিন ধরে উখিয়াতে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে আসছেন শিক্ষকেরা। কর্মসূচির চতুর্থ দিন আজ সকাল সাতটা থেকে কোর্টবাজারের পেট্রলপাম্প এলাকায় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকেরা। বেলা দেড়টা পর্যন্ত ছয় ঘণ্টা সড়ক অচল থাকায় টেকনাফ থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকা এবং কক্সবাজার থেকে টেকনাফগামী কয়েক হাজার যানবাহন আটকা পড়ে। তাতে নারী-শিশুসহ সাধারণ যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অবস্থান কর্মসূচির কারণে আশ্রয়শিবিরে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) লোকজন (কর্মকর্তা-কর্মচারী) ক্যাম্পে ঢুকতে পারেননি। তাঁদের গাড়িতে বাধার সৃষ্টি করেন শিক্ষকেরা।
বেলা ১১টার দিকে পুলিশ ও বিজিবির পাহারায় কয়েকটি এনজিও সংস্থার গাড়ি কোর্টবাজার অতিক্রম করে আশ্রয়শিবিরে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা এনজিওর গাড়িগুলো থামিয়ে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দেন। একপর্যায়ে গাড়িগুলো উল্টো পথে কক্সবাজার শহরের দিকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
বেলা একটার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আরিফ হোসেন ও উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সরওয়ার জাহান চৌধুরী। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা তাঁদের জানিয়ে দেন, অর্থসংকট থাকলে আশ্রয়শিবিরের সব শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে। তা না হলে চাকরিচ্যুত স্থানীয় শিক্ষকদের বহাল রাখতে হবে। এই ঘোষণা না পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা সড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করবেন না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থসংকটের কারণে ইউনিসেফের শিক্ষা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তার অংশ হিসেবে শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে। এটা অমানবিক হলেও ইউনিসেফের হাতে টাকা নেই। স্থানীয় শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতির বিষয়টি নিয়ে তিনি সরকারের উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলছেন। আশ্রয়শিবিরে ৪ হাজারের বেশি শিক্ষক আছেন। শিক্ষকদের যদি আপাতত এক বছর চাকরিতে রাখা হয়, তাহলে ৬০-৮০ কোটি টাকা প্রয়োজন। এই টাকা কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, তার চেষ্টা চলছে। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার কোর্টবাজার সড়ক অবরোধ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বলেন, সড়ক অবরোধ থাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। তাতে মানুষের দুর্ভোগ হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি মেনে নিয়ে আপাতত আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি।
৯০ কিলোমিটারের কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক ৬ ঘণ্টা অবরোধ থাকায় কয়েক হাজার যানবাহন আটকা পড়েছে। তাতে সাধারণ যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেকে কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে গন্তব্যে যাওয়ার চেষ্টা চালান। তবে অবরোধ চলাকালে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে ৭৮টির বেশি এনজিও কাজ করে। এসব সংস্থার অন্তত ২০ হাজার কর্মকর্তা সকাল ৭টা থেকে কক্সবাজার শহর থেকে এসে আশ্রয়শিবিরের কাজ সামলান। বিকেল ৪টার দিকে তাঁরা পুনরায় গাড়ি নিয়ে আশ্রয়শিবির থেকে কক্সবাজার শহরে ফিরে যান। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, অভিবাসন সংস্থা আইওএম, ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার শতাধিক কর্মকর্তাও শহর থেকে শিবিরে আসা–যাওয়া করেন। কিন্তু সড়ক অবরোধের কারণে আজ বেলা একটা পর্যন্ত কেউ আশ্রয়শিবিরে ঢুকতে পারেনি। আশ্রয়শিবিরগুলোতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি, আশ্রয়শিবিরগুলোতে শিক্ষা প্রকল্পের আওতায় তহবিল-সংকট দেখিয়ে বিনা নোটিশে স্থানীয় (বাংলাদেশি) শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু রোহিঙ্গা ও বহিরাগত (জেলার বাইরের) শিক্ষকদের চাকরিতে বহাল রাখা হয়। এটা বৈষম্য। শিগগির চাকরিতে পুনর্বহাল করা না হলে আশ্রয়শিবিরে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (আইএনজিও) কোনো গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা কেউ আমলে নেয়নি বলে আজকের এই সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে।
শিক্ষকদের প্রতিনিধি সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ চার দফা দাবি নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এ কারণে স্থানীয় ১ হাজার ২৫০ শিক্ষককে ছাঁটাই করা হয়েছে। এখন তহবিল–সংকটের কথা বলে দায় এড়ানোর চক্রান্ত চলছে। তহবিল-সংকটের কারণে স্থানীয় লোকজনের চাকরি না থাকলে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা প্রকল্পও বন্ধ করতে হবে। এই ঘোষণা না আসা পর্যন্ত আমরা মাঠ ছাড়ব না।’
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইউনিসেফের অর্থায়নে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এনজিও আশ্রয়শিবিরে শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। কিন্তু অর্থসংকটের কারণে শিক্ষা প্রকল্পটি বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। বিষয়টি ইউনিসেফ চিঠি দিয়ে সরকারকে জানিয়েছে। ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্প চালানোর অর্থ তাদের রয়েছে বলে চিঠিতে বলা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কিছু শিক্ষক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এর প্রতিবাদে চাকরিচ্যুত শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছেন।