পাগল হাসানের স্মরণোৎসবে গান গাইছেন আসিফ আকবর। আজ শনিবার সুনামগঞ্জের ছাতক পৌর শহরের পাগল হাসান চত্বরে
পাগল হাসানের স্মরণোৎসবে গান গাইছেন আসিফ আকবর। আজ শনিবার সুনামগঞ্জের ছাতক পৌর শহরের পাগল হাসান চত্বরে

পাগল হাসান বাংলা গানের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে: আসিফ

‘পাগল হাসানকে খুব মিস করি। আমি দেশে-বিদেশে তার গান গাওয়ার চেষ্টা করি। তার গান অত সহজ না। সে সৃষ্টিশীল মানুষ ছিল। সে তার ছোট্ট জীবনে যে দর্শন দেখিয়ে গেছে, সেটি ধরে রাখতে হবে। পাগল হাসান বাংলা গানের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে।’

সুনামগঞ্জে অকালপ্রয়াত সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার মতিউর রহমান হাসান ওরফে পাগল হাসানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণোৎসবে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথাগুলো বলেছেন দেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর।

আজ শনিবার বিকেলে সুনামগঞ্জের ছাতক পৌর শহরে প্রস্তাবিত পাগল হাসান চত্বরে এই অনুষ্ঠান হয়। পাগল হাসান স্মৃতি পরিষদ এই স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সংগীতশিল্পী পাগল হাসান গত বছরের ১৮ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় ছাতক শহরের সুরমা সেতুর পাশে মারা যান।

পাগল হাসানের পরিচয় প্রসঙ্গে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর বলেন, ‘প্রথম যেদিন তার সঙ্গে দেখা হয়, সে আমাকে বলে—ভাই, আমি পাগল হাসান। আমি ভাবি, যে নিজেই নিজেকে পাগল পরিচয় দেয়, সে তো সত্যি বড় পাগল। তাকে আমার ভালো লাগে।’ তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য আমরা তাকে হারিয়েছি। তার সঙ্গে আমার পারিবারিক একটা বন্ধন হয়ে গিয়েছিল। সে সবার ছিল। বাংলাদেশের মানুষ, বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষ জানুক পাগল হাসান কে ছিল। লন্ডন ও মধ্যপ্রাচ্যে তার অনেক ভক্ত–অনুরাগী আছেন। তাঁরা তাকে অনেকে ভালোবাসেন। আমরা তাকে ভালোবাসায় রাখব।’

আসিফ আকবর পাগল হাসানের মা, দুই ছেলেকে মঞ্চে নিয়ে এসে বলেন, ‘আমরা এই পরিবারের পাশে থাকব। এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব আমরা পালন করব।’ তিনি প্রস্তাবিত পাগল হাসান চত্বরটি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় সে জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান।

মঞ্চে পাগল হাসানের ‘ও মানুষ মইরা গেলে কদর বাইড়া যায়, বাঁইচা থাকতে নিকৃষ্ট কয়, মরলে শ্রেষ্ঠ পদক পায়...’ গানটি গেয়ে শোনান আসিফ আকবর। এই গানের মাধ্যমেই পাগল হাসানের সঙ্গে তাঁর সখ্য তৈরি হয়।

আলোচনা শেষে পাগল হাসানের গান পরিবেশন করেন ঢাকা থেকে আসা সংগীতশিল্পী কিশোর পলাশ, এফ এ সুমন, বন্যা তালুকদারসহ সুনামগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলের শিল্পীরা।

মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা যান পাগল হাসান। মরমি ভাবধারার বেশ কিছু গান লিখে, নিজে সেসব গানের সুর করে নিজেই গেয়েছেন। তাঁর গানগুলো মায়াভরা। তাঁর গায়কিতে ছিল ভিন্নতা। গান লিখতে হলে নাকি ‘বুকভরা পরম দুঃখের’ দরকার—নিজেই এমনটি বলেছিলেন পাগল হাসান। এই দুঃখবোধ তাঁর গান, সুর ও সাধনায় প্রকাশ পেয়েছে।

ছোটবেলায় বাবাকে হারান। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছিলেন। ‘মনের দুঃখ’ না মিটলেও একটু বৈষয়িক সুখ যখন উঁকি দিচ্ছিল, ঠিক তখন পথেই থেমে গেল তাঁর ‘ভাবজীবনের রেলগাড়ির ইঞ্জিন’।

সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার শিমুলতলা গ্রামে পাগল হাসানের জন্ম। কৃষক দিলোয়ার হোসেন ওরফে দিলশাদ ও আমিনা বেগমের একমাত্র ছেলে তিনি। বাবা দিলশাদ মারা যান যখন, তখন হাসানের বয়স পাঁচ। এরপর আমিনা বেগম ছেলেমেয়েদের নিয়ে অকূল দরিয়ায় ভাসেন। সন্তানদের বড় করতে, দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগাড় করতে নিজে শ্রমিকের কাজ করেছেন। হাসানকেও নানা জায়গায় কাজ করতে হয়েছে। মা চেষ্টা করে তাঁদের কিছু লেখাপড়া করান। দুচালা দুই কক্ষের টিনের বেড়া ও টিনের চালার ঘরে মা, স্ত্রী, দুই ছেলে আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকতেন। গান গেয়ে যা পেতেন বেশির ভাগই অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। এলাকায় কোথাও গানের আসর বা জলসা হলেই হাসান সেখানে হাজির হতেন। একপর্যায়ে ঢাকাসহ সবখানেই তিনি গান করতে থাকেন। ইউটিউবে তাঁর গান জনপ্রিয় হতে থাকে। তাঁর একটা গানের দল ছিল ‘পাগল এক্সপ্রেস’ নামে।