রংপুরের বদরগঞ্জে বিএনপির দুপক্ষের সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ১৫

রংপুরের বদরগঞ্জে সংঘর্ষে আহত দুই ব্যক্তি সড়কে পড়ে আছেন। আজ শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শহীদ মিনারের পাশে
ছবি: প্রথম আলো

রংপুরের বদরগঞ্জে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই পক্ষের সশস্ত্র সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। আজ শনিবার দুপুর ১২টার দিকে বদরগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে এ ঘটনা ঘটে।

নিহত ব্যক্তির নাম লাভলু মিয়া (৫০)। তিনি আজ বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। লাভলুর মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছেন তাঁর ছেলে রায়হান আলী।

আহতদের মধ্যে লাভলুসহ চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল। গুরুতর আহত নয়জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।

সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সদস্য মোহাম্মদ আলী সরকার আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাভলু আমার পারিবারিক সদস্য ও নিবেদিত একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তাঁকে অন্যায়ভাবে বদরগঞ্জ বাজারে প্রকাশ্যে মাথায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছেন কালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল হক ও তাঁর ছেলে তমালের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনী।’

তবে শহিদুল হক এই হামলার কথা অস্বীকার করে বলেন, তাঁর ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। এ ঘটনার সঙ্গে তিনি বা তাঁর ছেলে জড়িত নন।

আহতদের শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন

সংঘর্ষে গুরুতর আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন উপজেলার কাঁচাবাড়ি গ্রামের শরিফুল ইসলাম (৫৫), ময়নাল হোসেন (২৫), বৈরামপুর গ্রামের মোক্তারুল হোসেন (৫২), পাঠানপাড়ার মোন্নাফ হোসেন (৫০), মংলু মিয়া (৪০), মিতু হোসেন (৪২), জয়নাল হোসেন (৪৫) ও মুন্না খান (৪০)।

বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক শাকির মুবাশ্বির বলেন, আহত নয়জনের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। প্রত্যেকের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন আছে। এর মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

বদরগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত লাভলু মিয়া

সংঘর্ষ মোকাবিলায় ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা সতর্ক পাহারায় আছেন। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন মেহেদী প্রথম আলোকে বলেন, মূলত বদরগঞ্জ পৌর এলাকায় একটি টিনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। ঘটনাস্থলের আশপাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংঘর্ষের সূত্রপাত যেভাবে

বদরগঞ্জ পৌরবাজারের পাঁচজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ভাড়া জায়গায় জাহিদুল হক নামে এক ব্যক্তির একটি টিনের দোকান আছে। ওই দোকানের জায়গার মালিক হচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য ইসতিয়াক হোসেন।

জাহিদুল হক বলেন, দোকানের মালিক ইসতিয়াক হোসেনের কাছে তিনি দোকানটি ২০২৮ সাল পর্যন্ত ভাড়া নিয়েছেন। এ–সংক্রান্ত চুক্তিনামা আছে। তবুও ইসতিয়াক হোসেন তাঁকে দোকানটি দ্রুত ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছিলেন। গত বুধবার সন্ধ্যার পরে ইসতিয়াক হোসেন স্থানীয় বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী ও সমর্থককে নিয়ে লাঠিসোঁটা, ছুরি ও বল্লম হাতে তাঁর টিনের দোকানে হামলা করেন। এ সময় তাঁকে বেদম মারপিটসহ বাঁ পায়ে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হয়ে তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন।

গুরুতর আহত নয়জনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা বদরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন

স্থানীয় অন্তত পাঁচজন ব্যবসায়ী জানান, ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হন। জাহিদুল হকের পক্ষে অবস্থান নেন উপজেলা বিএনপির সদস্য ও কালুপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল হক ও স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা সারোয়ার জাহান। অন্যদিকে ইসতিয়াক হোসেনের পক্ষ নেন উপজেলা বিএনপির সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী সরকার এবং উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীর।

ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, গত বুধবার টিনের দোকানে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে বদরগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে জাহিদুল হকের পক্ষে মানববন্ধন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। গতকাল দুপুরে ব্যবসায়ী জাহিদুলের পক্ষে শহীদ মিনারের পাশে মানববন্ধন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। এ সময় দোকানমালিক ইসতিয়াক হোসেনের পক্ষাবলম্বনকারী উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীরের নেতৃত্বে দেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শতাধিক ব্যক্তি শহীদ মিনারে গিয়ে মানববন্ধনের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন। এর পরই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। তা চলে বেলা প্রায় একটা পর্যন্ত। এ সময় শহীদ মিনারের পাশে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুর রহমানের গাড়ির পেছনের কাচ ভাঙচুর করা হয়। তিনি ঈদের ছুটি শেষে ওই পথে স্ত্রী–সন্তানদের নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। এ সময় গাড়ির কাচ ভেঙে ভেতরে থাকা তাঁর শিশু সন্তান মাহরিন (৮) আহত হয়। হামলাকারীরা ওই স্থানে পথচারীদের আরও তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে।

সংঘর্ষের পরে সেনাসদস্যদের সতর্ক পাহারা। আজ শনিবার দুপুর সাড়ে আড়াইটার দিকে শহীদ মিনারের পাশে

মোহাম্মদ আলী সরকার অভিযোগ করেন, শুক্রবার রাতে তাঁর বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হকের ছেলে তমাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন পোস্ট দেন। এতে তাঁর (মোহাম্মদ আলীর) অনুসারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন।

জানতে চাইলে উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আমরা কোনো হামলা করিনি, কোনো গাড়িও ভাঙচুর করিনি। সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা মোহাম্মদ আলী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষরা ফেসবুকে অপপ্রচার ছড়িয়েছিল। এ কারণে তাঁর অনুসারীরা কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিল। প্রতিপক্ষ রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর ও টিনের দোকানে হামলা চালিয়েছে।’

ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল হক বলেন, তাঁর লোকজন কোথাও কোনো হামলা করেনি। নিরপরাধ একজন টিন ব্যবসায়ীর দোকানে হামলার প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে শহীদ মিনারের পাশে শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে প্রতিপক্ষ এসে হামলা চালিয়েছে।

বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, মূল ঘটনা একটা দোকান নিয়ে। দোকানকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। পুলিশ ও সেনা সদস্যরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে আছেন। অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।