লবণাক্ততার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে উপকূলের মাটিতে। সুপেয় পানির জন্য নারীদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হচ্ছে। জমিতে ফসল হচ্ছে না, মাছ চাষ শিকেয় উঠেছে। লবণাক্ত মাটিতে ভালো কোনো ঘাসও হচ্ছে না। গোখাদ্যের অভাবে গোয়াল থেকে কমছে গরু–ছাগল। উপকূলের মানুষের জীবন–জীবিকা তাই সংকটে। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে দেশের অন্য প্রান্তে।
এটি উপকূলের অনেক জেলা–উপজেলার সাধারণ চিত্র। এমন সংকট মোকাবিলায় আশার আলো দেখাচ্ছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা। লবণাক্ত জমিতে বিদেশি একধরনের ঘাস লাগিয়ে সাফল্য পেয়েছেন দুই গবেষক। তাঁরা বলছেন, এই ধরনের ঘাস চাষে উপকূলীয় অঞ্চলে গোখাদ্যের সংকট দূর হবে। কৃষকেরা গরু–ছাগল পালনে আরও উৎসাহী হবেন। এমন গবেষণা উপকূলবাসীর জন্য আশাজাগানিয়া, বলছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারাও।
বিশেষ ওই ঘাসের নাম পাকচোং। ঘাসের এই জাত এসেছে থাইল্যান্ড থেকে। এটি একটি উচ্চফলনশীল লম্বাটে, সবুজ ধরনের ঘাস। এটি সর্বোচ্চ ১৫ ডেসিসিমেন/মিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা (মাটিতে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ ২ ডেসিসিমেন/মিটারের বেশি হলে তাকে লবণাক্ত মাটি বলে। সূত্র: জাতীয় তথ্য বাতায়ন) সহ্য করতে পারে।
লবণাক্ত মাটিতে ঘাস নিয়ে চার বছর ধরে গবেষণাটি করে সাফল্য পেয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের (বিভাগ) অধ্যাপক মো. সফিকুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে রিসার্চ ফেলো হিসেবে ছিলেন বিসিএস লাইভস্টক একাডেমির পরিচালক পিযুষ কান্তি ঘোষ। উপকূলীয় এলাকায় কয়েক ধরনের ঘাসের চাষ নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা। এর মধ্যে পাকচোং ঘাসের উৎপাদনে আশানুরূপ সাফল্য পান।
‘ইফেক্ট অব স্যালাইনিটি স্ট্রেস অন গ্রোথ অ্যান্ড ইয়েল্ড অব ফরেজ জেনোটাইপস’ শিরোনামে তাঁদের গবেষণাকর্মটি ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সায়েন্টিফিক রিসার্চ পাবলিশিং গ্রুপের অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস জার্নালে প্রকাশিত হয়।
২০১৫ সালে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ‘উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত এলাকায় ঘাসের উৎপাদন বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকল্পের দায়িত্ব দেয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে। ২০১৭ সালে গবেষণাটি শুরু করেন ওই দুই গবেষক। দুটি ধাপে গবেষণাকাজ চলে। প্রথম ধাপে লবণাক্তপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত খুলনার দাকোপ, সাতক্ষীরার তালা ও বাগেরহাটের মোংলা উপজেলাকে চিহ্নিত করা হয়। এরপর ওই তিন উপজেলায় গবাদিপশু পালন করেন, এমন ১০০ জন কৃষকের ওপর প্রাথমিক জরিপ চালানো হয়।
জরিপে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ওই কৃষকেরা ৯৫৬টি গবাদিপশু পালন করেছিলেন। এর মধ্যে গরু ৭১৪টি, ছাগল ২২১ ও ভেড়া ছিল ২১টি। ২০১৭ সালে এসে তাঁদের গবাদিপশুর উৎপাদন কমে যায়। তখন ওই ১০০ কৃষকের গোয়ালে ২৫২টি গবাদিপশু কম ছিল। গবাদিপশু কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়—গোখাদ্যের স্বল্পতা।
কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে দ্বিতীয় ধাপের গবেষণা শুরু হয়। ওই ধাপে বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭টি বিভিন্ন জাতের ঘাসের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে চাষের ব্যবস্থা করা হয়। ওই ঘাসের মধ্যে দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন ধরনের ঘাস ছিল।
শুরুতে ১৭টি জাতের ঘাসকে সর্বোচ্চ লবণাক্ততার মাধ্যমে টবে চাষ করেন গবেষকেরা। সেখান থেকে ভালো লবণসহিষ্ণু জাত চিহ্নিত করা হয়। পরে ওই জাতগুলো দকোপ, তালা ও মোংলার লবণাক্তপ্রবণ এলাকায় চাষের ব্যবস্থা করা হয়। লবণাক্ত এলাকায় চাষের জন্য কী ধরনের সার প্রয়োগ করা উচিত, সেটিও ওই গবেষণায় তুলে নিয়ে আসেন গবেষকেরা। তিন বছর এভাবে চাষের পর গবেষকেরা দেখতে পান, পাকচোং জাতের ঘাস সঠিক সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চাষ করতে পারলে সর্বোচ্চ লবণাক্ত এলাকাতেও চাষ করা সম্ভব। এটি ১৫ ডেসিসিমেন/মিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে।
পাকচোং ঘাস ৬০ দিনেই গোখাদ্যের জন্য উপযুক্ত হয়। তবে গবেষণার জন্য এটি ৯০ দিন পর্যন্ত রাখা হয়। ঘাস চাষের পর ৬০ দিন পর কেটে গবাদিপশুকে খাওয়ানো যায়। এরপর উন্নত পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতি ৪৫ দিন পরপর ঘাস কাটা যায়। একবার রোপণ করলে সামান্য যত্নে পাঁচ বছর পর্যন্ত এই ঘাস উৎপাদন হবে।
উপকূলীয় এলাকায় পাকচোং ঘাসের গড় উচ্চতা ১৪৯ সেন্টিমিটার। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ঘাস ৫০ দিনে ৩৬ মেট্রিক টন ও ৯০ দিনে ৭৪ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়। সে ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত নেপিয়ার জাতের ঘাস উৎপাদন হয় ৫০ দিনে ২৮ মেট্রিক টন ও ৯০ দিনে ৫০ মেট্রিক টন। এই ঘাস রোপণের উপযুক্ত সময় ফাল্গুন-চৈত্র মাস (মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য এপ্রিল)।
গবেষক সফিকুল ইসলাম বললেন, পাকচোং ঘাস পুষ্টিমান বিবেচনায় খুবই উন্নত। ওই ঘাসে ৭০ শতাংশের বেশি জলীয় পদার্থ ও অন্যান্য ঘাসের মতোই আমিষ থাকে। ঘাসটিতে খাদ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আঁশ আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। গড়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি চর্বি থাকে এতে। এই ঘাস সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক খাদ্য বলে এটি গ্রহণে প্রাণীর শরীরে কোনো ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। এমনকি প্রাণী থেকে উৎপাদিত দুধ ও মাংস মানবস্বাস্থ্যের জন্যও নিরাপদ।
গবেষণাটি খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে দাবি করে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এখন সরকারকে এই প্রযুক্তি সাধারণ কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ঘাস চাষ করতে পারলে উপকূলীয় এলাকায় গবাদিপশু উৎপাদনে বিপ্লব দেখা দিতে পারে।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বরণপাড়া এলাকায় বড় আকারের একটি গবাদিপশুর খামার করেছেন মিজানুর রহমান। তাঁর খামারে প্রায় ৩০০টি ছোট–বড় গরু আছে। গোখাদ্য হিসেবে ১৪ বিঘা জমিতে এই ঘাস চাষ করেছেন তিনি। মিজানুর রহমান বললেন, এক বছর আগে প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের পরামর্শে পাকচোং ঘাস চাষ শুরু করেন। অন্যান্য ঘাসের চেয়ে এই ঘাসের উৎপাদন অনেক বেশি।
ফুলতলার উত্তরদিহি গ্রামে প্রায় এক বিঘা জমিতে পাকচোং ঘাসের চাষ করেছেন গৌরাঙ্গ কুমার রাহা। তিনি বলেন, ঘাসের পুষ্টিগুণ ও উৎপাদন অনেক ভালো।
গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের জন্য ঘাসটি বেশ উপকারী বলে মন্তব্য করলেন খুলনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এস এম আইয়ুব আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চফলনশীল ঘাসটি উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় ভালো জন্মে।