অন্য খবর

‘কৃষকের শিক্ষক’ আবু বকর, শেখান আধুনিক চাষাবাদ

নিজের আখখেতের পরিচর্যা করছেন আবু বকর সিদ্দিক। গত সেপ্টেম্বরে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। কৃষিকাজটাও করেন যত্ন নিয়ে। আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রকৃতিবান্ধব চাষাবাদে ঝোঁক তাঁর। নিজ উদ্যোগে আরেকটি কাজ করেন তিনি। গ্রামের কৃষক, যুবকদের আধুনিক চাষাবাদের ওপর প্রশিক্ষণ দেন। কেউ মাল্টা চাষ করবেন, কেউ করবেন ড্রাগনের চাষ।

বুদ্ধি–পরামর্শের জন্য আসেন তাঁর কাছে। নিজে বইপত্র পড়ে, ইন্টারনেট, ইউটিউব ঘেঁটে তবেই পরামর্শ দেন চাষিদের। এ কাজ করতে গিয়ে নিজ গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের তরুণ–যুবক ও চাষিদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছেন। এ জন্য অনেকে তাঁকে ‘কৃষকের শিক্ষক’ বলেও ডাকেন।

এই শিক্ষকের নাম আবু বকর সিদ্দিক (৫০)। বাড়ি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার মাটিভাঙ্গা গ্রামে। কৃষিকাজ বেছে নিয়েছিলেন দ্বিতীয় পেশা হিসেবে। সেই দ্বিতীয় পেশাই তাঁকে এনে দিয়েছে খ্যাতি। ২০১৭ সালে আদর্শ কৃষক হিসেবে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি রৌপ্যপদক। আমন ধান কাটার পর জোয়ারে তলিয়ে যাওয়া জমিতে সবজি চাষের পদ্ধতি বের করে সবার নজর কাড়েন আবু বকর। তাঁর সেই পদ্ধতিই এনে দিয়েছিল জাতীয় পুরস্কার।

আবু বকরকে অগ্রগামী ও উদ্ভাবনী কৃষক বলে মনে করেন ভান্ডারিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আবু বকর চাষাবাদে প্রযুক্তির সহযোগিতা নেন। কৃষি বিভাগ তাঁকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছে। আমাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি এখন নিজ উদ্যোগে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।’

প্রযুক্তিনির্ভর কৃষক

আবু বকর বিভিন্ন সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আধুনিক চাষাবাদের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া জ্ঞান, নিজের অভিজ্ঞতা ও ইন্টারনেট ঘেঁটে পাওয়া তথ্য কাজে লাগিয়ে তিনি কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার করে সফল হয়েছেন। তিন বছর ধরে আধুনিক চাষাবাদের উন্নত পদ্ধতি মালচিং ব্যবহার করে সবজি ও ফল চাষ করছেন। কীটনাশকের ব্যবহার না করে হলুদ ফাঁদ, বিষফাঁদ, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করে পোকা দমন করেন।

কথা হয় তাঁর সবজি চাষের পদ্ধতি নিয়ে। ডিসেম্বর মাসে আমন ধান কাটার পর জমিতে বেড পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষাবাদ করেন। শুরুতে জমির একাংশ থেকে মাটি কেটে এনে অপর অংশ উঁচু করেন। যেন জোয়ারে খেত তলিয়ে না যায়। পরে সেই উঁচু জমিতে সবজির চাষ করেন। সবজি তোলা শেষে জমির মাটি সমান করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। পরে আবার ধান চাষ করা হয়। নিচু জমিতে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে তিনি কৃষি পুরস্কার পেয়েছিলেন।

মাটিভাঙ্গা গ্রামের কৃষক জসিম উদ্দিন (৩৫) বলেন, ‘আমি একসময় শুধু ধান চাষ করতাম। পরে বকর ভাইয়ের কাছ থেকে মৌসুমভিত্তিক শাক, সবজি ও ফল চাষের ধারণা নিই। এরপর থেকে সবজি চাষে সাফল্য পেয়েছি।’

একাধারে শিক্ষক ও কৃষক

মাটিভাঙ্গা গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে আবু বকরের জন্ম। কিশোর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে গেছেন। ১৯৯৪ সালে স্নাতক পাস করে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি স্থানীয় মোন্তাজিয়া দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক। সামান্য বেতনের টাকায় পরিবারের খরচ চালানো কষ্ট হয়ে পড়ে। তখন আবু বকর বাড়তি আয়ের জন্য আবার কৃষিকাজ শুরু করেন।

আবু বকর বলেন, সকালে উঠেই তিনি মাঠে যান। সেখানে এক দফা কাজ করে মাদ্রাসায় যান। মাদ্রাসা ছুটির পর আবার খেতে কাজ করেন। প্রথমে কলাচাষ দিয়ে শুরু করেন। এরপর আখ ও মৌসুমভিত্তিক শাকসবজি চাষ করেন। প্রথমে বর্গাচাষি হিসেবে কৃষিকাজ শুরু করেন। পরে সবজি বেচে বাড়তি আয় দিয়ে তিন বিঘা জমি কিনেছেন। তিন ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তাঁর সংসার।

কৃষকদের ভরসাস্থল

আবু বকরকে দেখে পূর্ব মাটিভাঙ্গা গ্রামের অনেক বেকার যুবক শাকসবজি চাষ শুরু করেন। শুরুতে প্রায় প্রতিদিনই আশপাশের গ্রামের তরুণ–যুবকেরা চাষাবাদের বিষয়ে পরামর্শ নিতে তাঁর কাছে আসতেন। তখন আবু বকর সিদ্ধান্ত নেন, গ্রামের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘কৃষক মাঠ স্কুল’–এর কার্যক্রম শুরু হয় তাঁর বাড়ির আঙিনায়। সেখানে সপ্তাহে এক দিন ৩০ জন নারী ও ৩০ জন পুরুষকে নিয়ে কৃষি বিষয়ে নানা আলোচনা ও প্রশিক্ষণ হতো। সে কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল আবু বকরের। অবশ্য সরকারের সেই কার্যক্রম এখন আর নেই। কিন্তু অন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, কৃষকদের বুদ্ধি–পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা অব্যাহত রেখেছেন আবু বকর।

আবু বকর বলেন, ‘উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে মাল্টা, ড্রাগনসহ বিভিন্ন ফল চাষের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এ ছাড়া ইন্টারনেট ও ইউটিউব দেখে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ উপায়ে ফসল উৎপাদন ও উচ্চ আয়ের ফসল যেমন সাম্মাম, অসময়ের তরমুজ ইত্যাদি চাষাবাদের বিষয়ে জানতে পেরেছি। এখন প্রশিক্ষণ থেকে আমার অর্জিত জ্ঞান আর নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তরুণ কৃষকদের জানানোর চেষ্টা করি।’

গ্রামের কৃষক ও বেকার যুবকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাঁদের আর্থিকভাবেও সহায়তা করেন আবু বকর। কৃষকদের কাছে ন্যায্যমূল্যে সার, বীজ ও কীটনাশক বিক্রি করেন তিনি। গ্রামের বাজারে তাঁর একটি দোকান আছে। দরিদ্র কৃষকেরা এই দোকান থেকে বাকিতেও পণ্য কেনেন।

মাটিভাঙ্গা গ্রামের হাফিজুর রহমান, ইমরান হোসেন, জসিম উদ্দিন, আবদুস সত্তার, শাকিল হাওলাদার, পাশের রাজাপুর উপজেলার মিনারা বেগম, সালাম খান, কাঁঠালিয়া উপজেলার কালাম জমাদ্দার, সায়েদ হাওলাদার, ফোরকান মৃধা, রুস্তম আলী তাঁর পরামর্শ নিয়ে কৃষিকাজ করে সাফল্য পেয়েছেন, আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন।

কৃষকহাফিজুররহমানবলেন, ‘আবুবকরভাইয়েরকাছথেকেঅনেকপরামর্শনিই।অনেককৃষকতাঁরমাধ্যমেউপকৃতহয়েছেন।’