মৌলভীবাজারের কামালপুর বাজারে ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ণ মাসের সময়টিতে সপ্তাহে দুই দিন সুপারির হাট বসে
মৌলভীবাজারের কামালপুর বাজারে ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ণ মাসের সময়টিতে সপ্তাহে দুই দিন সুপারির হাট বসে

সকাল হলেই জেগে ওঠে এক বেলার ‘সুপারি হাট’

বাজারটি প্রায় শত বছরের পুরোনো। উনিশ শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকে মনু নদের পাড় ঘেঁষে হাটটি গড়ে উঠেছে। কালের যাত্রায় হাটটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাজারের আয়তন বেড়েছে, দালানকোঠা তৈরি হয়েছে। এই অনেক কিছুর বদল হয়েছে, তবে বদল হয়নি শরৎ-হেমন্তকালের হাটে সপ্তাহে অন্তত দুই দিনের চেহারা। ওই দুই দিন সকাল হলেই আলাদা চেহারা নিয়ে জেগে ওঠে ‘সুপারি হাট’।

সুপারির হাটটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর বাজারের। ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের দুই পাশে বিস্তৃত দোকানপাট নিয়ে বাজারটি কমবেশি সব রকম পণ্যেরই হাট। শুধু সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার—এই দুই দিন ব্যতিক্রম। ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ণ মাসের সময়টিতে এই দুই দিন সকালবেলা বাজারটিতে আলাদা করে সুপারির হাট বসে। কামালপুর বাজারের সুপারির হাটটি আলাদা করে অনেকের কাছে পরিচিত।

গত মঙ্গলবার সাতসকালে মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠতেই সুপারি হাটের ঘ্রাণ পাওয়া গেছে। অটোরিকশায় দুটি প্লাস্টিকে বস্তায় পণ্য নিয়ে উঠলেন আশিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তি। তাঁর দুটি বস্তাতেই সুপারি। তাঁর বাড়ি কামালপুর বাজারের কাছেই রাধানগরে। কিন্তু তিনি থাকেন মৌলভীবাজার শহরে। শহরের বাসার গাছের সুপারি বিক্রি করতে তিনি কামালপুর বাজারে যাচ্ছেন। পথে ওই অটোরিকশায় আরও একজন উঠলেন সুপারির বস্তা নিয়ে। হাটে পৌঁছাতে তখন সকাল সাতটার কাছাকাছি।

এর মধ্যে অনেক বিক্রেতা হাটে চলে এসেছেন। হাটের একটি অংশে ক্রমে সুপারি কেনাবেচার স্থানটি জমে উঠতে শুরু করেছে। অটোরিকশা, অটোভ্যানসহ নানা বাহনে সুপারি নিয়ে হাটে আসছেন বিক্রেতারা। কেউ আসছেন নিজের গাছের সুপারি নিয়ে। এর মধ্যে কেউ আছেন পাইকার, যাঁরা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে সুপারি কিনে এই হাটে এনে বিক্রি করেন।

অটোরিকশাসহ নানা মাধ্যমে সুপারি নিয়ে হাটে আসেন বিক্রেতারা

কিছুটা সময় গড়াতেই হাটটি জমজমাট চেহারা নিয়ে ফেলে। কেউ বস্তার সুপারি খুলে মাটিতে মেলে ধরেন। কেউ বস্তার মুখ খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। কেউ কাঁচা সুপারিও নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যেই পাইকাররা দরদাম করছেন। দরদামে পোষালে একটু আড়ালে সরে গিয়ে গণনা শুরু হচ্ছে। পাইকাররা যাঁর যাঁর মতো স্থানে স্তূপ করে রাখছেন সুপারি। সময় গড়ায়, আর সুপারি নিয়ে আসা লোকজনের সংখ্যাও বাড়তে থাকে; বাড়তে থাকে হইচই, কোলাহল। সরগরম হয়ে ওঠে সুপারির হাট। হাটটিতে সুপারির ছড়াছড়ি দেখে মনে পড়ে যায় ‘পান খাইতে সুপারি লাগে আরও লাগে চুন/ ভালোবাসতে মন লাগে আরও লাগে গুণরে বন্ধু/ আরও লাগে গুণ’ গানের এই পঙ্‌ক্তি।

সদর উপজেলার জমুনিয়া গ্রামের রানা মিয়া বেশ কিছু বস্তাবোঝাই পাকা সুপারি নিয়ে হাটের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি জানান, তাঁরা গ্রামের এক ব্যক্তির বাড়িতে আগাম প্রায় দুই হাজার সুপারিগাছের ফসল কিনে রেখেছিলেন। মাসখানেক ধরে কামালপুর বাজারের সাপ্তাহিক হাটবারে এই সুপারি নিয়ে আসছেন, বিক্রি করছেন। যত দিন গাছে সুপারি আছে, তত দিনই এই বিক্রি চলতে থাকবে।

মৌলভীবাজার সদরের কামালপুর বাজারের সুপারির হাটটি আলাদা করে অনেকের কাছে পরিচিত

স্থানীয় লোকজন ও বিক্রেতাদের সূত্রে জানা গেছে, হাটে প্রতি ‘ঘা’ সুপারি (১০টিতে ১ ঘা) আকার অনুযায়ী ২০ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় আকারের সুপারিগুলো ৩৫ থেকে ৪০ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।

আশপাশের গ্রামের লোকজন আসতে আসতে সকাল ৮টা, ৯টা বা ১০টা বেজে যায়। তাঁরা সকালবেলা গাছ থেকে সুপারি পেড়ে সরাসরি হাটে আসেন। টুকরি নিয়ে এ রকম অনেককেই হাটে আসতে দেখা গেছে। এই হাটে বৃহত্তর সিলেটের নবীগঞ্জ, ইনাতগঞ্জ, গোয়ালাবাজার, টেংরা, আদমপুর, শমসেরনগর, শ্রীমঙ্গলসহ বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এসে সুপারি কিনে নিয়ে যান। সকাল ১০টার দিকে হাটটি পুরো জমে যায়। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে বেশির ভাগ বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়। এরপরও কারও যদি ফসল থাকে, তাহলে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে পারে। তবে সাধারণত দুপুরের মধ্যে সুপারির হাটটি গুটিয়ে যায়। বিকেল হলে হাটের অন্য পণ্য আসতে শুরু করে। বাজারটি নতুন করে চেহারা নিতে থাকে। তখন মনেই হয় না, এখানে সকালবেলা শুধু সুপারি নিয়ে একটি হাট বসেছিল।