
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করা হয় কক্সবাজারের রামু উপজেলার প্রাচীন ১২টি বৌদ্ধবিহার। পরের দিন উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধবিহার ও হিন্দু মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় ১৯টি মামলার মধ্যে ১টি আপসে নিষ্পত্তি হলেও ১৮টি মামলা কক্সবাজারের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন আছে। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে বিচারকাজ শুরু করা যাচ্ছে না। মামলাগুলোর ১৬৭ সাক্ষীর বেশির ভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন।
‘এ হামলা ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত ও পূর্বপরিকল্পিত। কিন্তু এর বিচার হবে না’, বলে মনে করেন রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের আবাসিক পরিচালক ও কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু। ওই হামলার ঘটনা, এ ঘটনায় করা মামলাগুলোর সাক্ষী ও বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রথম আলোর কক্সবাজারের নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কুদ্দুস।
প্রথম আলো: সেদিনের হামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন আপনি। ওই হামলা কেন হয়েছিল বলে মনে করেন?
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: বিভিন্ন স্থিরচিত্র, ভিডিও ফুটেজ ও তদন্ত প্রতিবেদনে প্রমাণ মিলেছে, এ হামলা ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষপ্রসূত ও পূর্বপরিকল্পিত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হামলার ঘটনা ঘটে, বিষয়টা এমন নয়। সন্ধ্যা থেকে যে উন্মাদনা শুরু হয়েছিল, এর চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে মধ্যরাতে। আমরা সেদিন দেখেছি, প্রথমে ধর্ম অবমাননার গুজব রটিয়ে লোকজনকে খেপানো হলো। সময় যত গড়াতে থাকল, উন্মাদনা ততই বাড়ল। দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও তৎকালীন স্থানীয় ও জেলা প্রশাসন সেই উন্মাদনা ও সাম্প্রদায়িক আস্ফালন থামানোর পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো দায়িত্বশীল কারও কারও বিরুদ্ধে বিষয়টিকে আরও উসকে দেওয়ার অভিযোগ আছে। ঘটনার পর থেকে শুরু হলো দোষারোপের রাজনীতি।
প্রথম আলো: হামলার জন্য রামুকেই কেন বেছে নেওয়া হলো?
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: দুটি দিক বিবেচনা করে রামুতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ১. রামুতে যুগ যুগ ধরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অনেক লোক বাস করছে। ২. উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে এখানে। রামুতে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে পারস্পরিক সহাবস্থানের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। তাই পরিকল্পনাকারীরা তাঁদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে রামুকে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁরা সফলও হয়েছেন।
প্রথম আলো: বিচার নিয়ে কী বলবেন?
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: রামু হামলার ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে কেবল একটি মামলার বাদী ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি, যেটি ২০১৫ সালের দিকে মীমাংসা হয়ে গেছে। অপর ১৮টি মামলার বাদী পুলিশ। যতদূর জানি, আদালতে এসব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১০ বছরে একটি মামলারও বিচারিক কার্যক্রম শেষ করা যায়নি। সাক্ষীর অভাবে নাকি বিচার কার্যক্রম এগোনো যাচ্ছে না।
প্রথম আলো: সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে যাচ্ছেন না কেন?
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: ঘটনার পর পর ভুক্তভোগীদের মধ্যে যে আবেগ, ক্ষোভ ও দায়বোধ কাজ করেছে, ঘটনার দীর্ঘ সময় পরে এসে সে ক্ষেত্রে ভাটা পড়েছে। অনেকের আক্ষেপ, যাঁরা সেদিন ঘটনার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন, মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের নাম অভিযোগপত্রে নেই। আবার অনেকে এখন লাভ-ক্ষতি, নিরাপত্তা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন হিসাব কষছেন। মামলায় অভিযুক্তদের কেউ কেউ কিছুদিন জেলও খেটেছেন। অনেক আগে থেকেই তাঁরা জামিনে মুক্ত আছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে সাক্ষীদের দেখা হয়, কথা হয়। সবাই সবার চেনাজানা, প্রতিবেশী। এখন ঘটনার দীর্ঘ সময় পরে এসে তাই সাক্ষী পাওয়া অনেকটা মুশকিল হয়ে পড়েছে। সাক্ষীরা যদি শেষ পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্য না দেন, তাহলে কোনো একসময় আসামিরা মামলা থেকেও খালাস পেয়ে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, রামু হামলার বিচার হবে না।
প্রথম আলো: এখন রামুর বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতি কেমন বলে মনে করেন?
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: এখন আগের মতো থমথমে পরিস্থিতি নেই। সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ), র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন), গোয়েন্দা সংস্থাসহ সবাই যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। নিরাপত্তাব্যবস্থাও ভালো।
প্রথম আলো: আমরা জানি যে স্থানীয় উত্তম বড়ুয়ার বিরুদ্ধে ফেসবুকে পবিত্র কোরান শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে এ হামলা করা হয়েছিল। এখন উত্তম বড়ুয়া কোথায়? তাঁর পরিবারের অবস্থা কী?
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: হামলার ভয়ে সেদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন উত্তম। এরপর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। উত্তমের পরিবারকেও দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। হামলায় ক্ষতিগ্রস্তরা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা সহায়তা-অনুদান পেলেও কিছুই পায়নি উত্তমের পরিবার। সে সময় সামাজিকভাবেও কোণঠাসা ছিল পরিবারটি। সব মিলিয়ে অভাব ও অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
প্রথম আলো: ফেসবুকে গুজবে ছড়িয়ে রামুতে হামলা হয়েছিল। এরপর একই কায়দায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় মন্দির-বিহার ও সংখ্যালঘুদের বসতিতে হামলা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু: গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়াটা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অতি সহজ হয়ে গেছে। অনেক সময় ফেক আইডি খুলে এসব করে বিভিন্ন স্বার্থ হাসিল করা হয়। কেউ কেউ এভাবে শত্রুকে ঘায়েল করে। ফেসবুকে কীভাবে কারসাজি হয়, গুজব ছড়ানো হয়, এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সারা বছর প্রচারণা চালানো জরুরি। এ ছাড়া গুজব রটনা করা ব্যক্তিদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার বিকল্প নেই।