সিরাজগঞ্জের কাজীপুর

কম্বল তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন গ্রামে, যাচ্ছে সারা দেশে 

কম্বলের বাজারখ্যাত শিমুলদাইড় বাজারের দোকানে দোকানে চলছে নতুন আর ঝুট কাপড়ের কম্বল তৈরির কাজ। ক্রেতারা ভিড় করছেন এসব দোকানে। 

সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের কম্বল এখন দেশজুড়ে সুনাম কুড়াচ্ছে। কম্বল তৈরি আর বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার শিমুলদাইড় বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের শিমুলদাইড় বাজার। গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। চারদিকে কুয়াশা। শীতের মাত্রা গত কয়েক দিনের চেয়ে খানিকটা বেশি। এ কারণে সকাল সকাল জমজমাট হয়ে উঠেছে কম্বলের বাজারখ্যাত শিমুলদাইড় বাজারটি। দোকানে দোকানে চলছে নতুন আর ঝুট কাপড়ের কম্বল তৈরির কাজ। ক্রেতারা ভিড় করছেন এসব দোকানে। 

কথা হয় শিমুলদাইড় বাজারের ব্যবসায়ী আর ক্রেতাদের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, কম্বলের সঙ্গে শিশুদের শীতের জামাকাপড়ও তৈরি হচ্ছে এলাকার বিভিন্ন গ্রামে। পাশের গ্রাম ছালাভরা কুনকুনিয়া। ওই গ্রামের আবদুল খালেক নব্বইয়ের দশকে শুরু করেন পোশাক কারখানার ঝুট কাপড় দিয়ে কম্বল তৈরির কাজ। দামে কম, কিন্তু খুবই গরম হওয়ায় এসব কম্বল প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে এ কম্বল শীত থেকে বাঁচার উপায় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, তখন একটি লেপ তৈরি করতে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ হতো। অথচ ঝুট কাপড়ের একটি কম্বলের দাম ছিল ১০০ থেকে ২০০ টাকা।

দিন দিন ঝুট কাপড়ের তৈরি কম্বলের চাহিদা বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে নতুন কাপড়ের কম্বল তৈরি হতে থাকে। বর্তমানে এখানকার তৈরি কম্বল উত্তরের ১৬ জেলা, দক্ষিণবঙ্গ, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বাজারজাত করা হচ্ছে। কম্বলের সঙ্গে শিশুদের শীতের জামাকাপড়ও তৈরি হচ্ছে এলাকার বিভিন্ন গ্রামে।

শিমুলদাইড় বাজার কম্বল সমিতির সদস্য হিসেবে তিন শতাধিক ব্যবসায়ী আছেন। সমিতির সভাপতি ও সহিহ ট্রেডার্সের মালিক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, এ মৌসুমে ব্যবসায়ীরা প্রায় ৫০ লাখ কম্বল তৈরি করে বিক্রির টার্গেট করেছেন। এতে শতকোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এ পর্যন্ত অর্ধেক কম্বল বিক্রি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাকি কম্বল জানুয়ারির দুই সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি হবে। তবে শীতের মাত্রা বাড়লে কম্বল বিক্রি হতে সময় কম লাগবে। সেই সঙ্গে নতুন করে আরও কিছু কম্বল তৈরি করতে হবে।

বাজারের কম্বল ব্যবসায়ী আয়নুল হক বলেন, কম্বল তৈরির কাঁচামাল ঝুট কাপড় কিনে আনতে হয় ঢাকার মিরপুর, সাভার, গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ী আর চট্টগ্রাম থেকে। নতুন কাপড় আসে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম আর ঢাকার নবীনগর থেকে। এখানে শীতের প্রয়োজনীয় কম্বলের পাশাপাশি শৌখিন ও উপহার দেওয়ার মতো কম্বলও তৈরি হচ্ছে জানিয়ে মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, এসব কম্বল ১ হাজার থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে শীত নিবারণের জন্য ঝুট কাপড়ের কম্বল ১৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়। নতুন কাপড়ের কম্বল ৯০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।

কম্বল তৈরির কাজে প্রথমে নারীরা যুক্ত হলেও বর্তমানে পুরুষেরাও যুক্ত রয়েছেন। এ শিল্পে বর্তমানে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষ যুক্ত রয়েছেন। বাজারের ব্যবসায়ী আল আমিন বলেন, চলতি মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার কম্বল তৈরি করা হয়েছিল। শীতের মাত্রা কম থাকায় আশানুরূপ বিক্রি হয়নি। তবে শেষের দিকে শীতের তীব্রতা বাড়ায় বিক্রি বাড়ছে।

শিশুদের শীতের জামাকাপড় তৈরি করে বিক্রি করেন আয়েশা খাতুন। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। সেখানে কাজ শিখে চিন্তা করলাম, এলাকায় ফিরে আমরাই এসব তৈরি করে বিক্রি করব।’ এলাকার অনেকেই এখন তাঁর মতো ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন বলে জানান তিনি। আদুরী খাতুন নামের আরেকজন বলেন, ‘এখন আমরা পরিবারের বোঝা নই, আমরা আয় করি। শিশুদের এসব শীতের পোশাক পাইকারি হিসাবে বিক্রি করা হয়। প্রতিটি পায়জামা ৫ থেকে ২০ টাকায় এবং জামা ৪০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়।’

এলাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী আয়নাল হক বলেন, পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়েদের বিয়ের সময় একটি সেলাইমেশিন দেওয়া হয়। এ মেশিন আর ঝুট কাপড় তাঁর জীবনের চাকা ঘোরাতে সহায়তা করে। 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুখময় সরকার গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যমুনা নদীর ভাঙনে প্রায় নিঃস্ব হওয়া মানুষেরা কম্বল তৈরির কাজ করে এখন আর্থিকভাবে অনেক স্বাবলম্বী। কম্বল ব্যবসায়ীদের পাশে আমরা ছিলাম, থাকব।’