রিয়াদ হাসান
রিয়াদ হাসান

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর লেখা

কালুরঘাইট্টা মুড়ির টিন 

কর্ণফুলীর শান্ত স্রোত ছুঁয়ে নির্মল বাতাস এসে খেলা করে কালুরঘাটের ইস্পাহানী জুট মিল কলোনিতে। সে বাতাসেই বড় হয়েছেন রিফাত হাসান। দুর্লভ প্রতিভার এই মানুষটিকে সবাই চেনে রিয়াদ হাসান বা রিয়াদ নামে। সংগীতের তিনটি প্রধান বিষয়ের বিষ্ময়কর সম্মিলন ঘটেছে তার মধ্যে। তিনি গান লেখেন, তাতে সুর দেন আর সেই গান গেয়ে শ্রোতাদের পাগল করেন। গীতিকার, সুরকার আর কণ্ঠশিল্পী এই তিনটি পরিচয়েই তিনি পরিচিত। তার গাওয়া গান কোক স্টুডিও প্রযোজিত ‘মুড়ির টিন’ এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ভাইরাল। কালুরঘাটের জুট মিল কলোনি থেকে শুরু করে কোক স্টুডিওত পর্যন্ত রিয়াদের পথচলা সত্যিই এক অনুপ্রেরণার গল্প। বাড়ির পাশে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলীর স্রোতের মতোই তার গানও বয়ে চলে মাটির গন্ধ আর মানুষের গল্প নিয়ে। সংগীতই তার ভালোবাসা, যাত্রাপথের সঙ্গী। 

গানেই শৈশবের শুরু

রিয়াদের সংগীতযাত্রা শুরু হয় একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে। ছোটবেলায় বড় ভাই মিরাজুলের দেওয়া উপহার একটি “ন্যাশনাল টু ইন ওয়ান” রেডিও-ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতে শুনতেই সংগীতের প্রেমে পড়েন তিনি। কলোনির নিরিবিলি বিকেল, বড় ভাইদের গানের আসর, শান্ত সবুজ প্রকৃতি—সব মিলিয়ে শিশুর মনে গানের বীজ বপন হতো অজান্তেই। 

ছেলের আগ্রহ দেখে মা আনোয়ারা বেগম ও সেজ খালা ২০০০ সালে ৪২০০ টাকা খরচ করে এনে দেন একটি গিবসন গিটার। সেই গিটার হাতে নিয়েই শুরু হয় রিয়াদের সংগীতযাত্রা। পরে তিনি চার বছর ক্লাসিক্যাল ভোকালের তালিম নেন সুরবন্ধু অশোক চৌধুরীর কাছে। এসএসসি শেষের পর মা উপহার দেন একটি হারমোনিয়াম। বাবা আকতার উল আলম ছিলেন ইস্পাহানি জুট মিলের কর্মকর্তা, মা ছিলেন গৃহিণী। এই মুহূর্তে কানাডায় অবস্থান করায় গত মঙ্গলবার হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় রিয়াদ হাসানের সঙ্গে। দুই ভাই এক বোনের পরিবারে সবচেয়ে ছোট সন্তান রিয়াদ জানালেন, “মূলত ভালো লাগা থেকেই গান শুরু করেছিলাম। গানটা কখনোই ছাড়তে পারিনি। চাকরি করার পাশাপাশি গানই থেকেছে আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ”

পড়াশোনা ও পেশা

চট্টগ্রামের মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি স্মৃতি বিদ্যালয়ে স্কুল ও সরকারি সিটি কলেজে কলেজজীবন শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা পাড়ি জমান রিয়াদ। ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন তিনি। বর্তমানে কর্মরত আছেন একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে। ব্যস্ত চাকরিজীবনের মধ্যে সংগীতই তাঁর নিশ্বাস, তাঁর প্রতিদিনের সঙ্গী। 

গানের পথে প্রথম পদচারণা

চট্টগ্রামের তরুণ শ্রোতাদের কাছে রিয়াদের নাম প্রথম শোনা যায় ২০০৭ সালে—ব্লুটুথে ছড়িয়ে পড়া গান ‘জিইসি মোড়’ দিয়েই। শহরের গল্প, মাটির টান আর জীবনের ছোট ছোট অনুভূতি মিশে ছিল সেই গানে। এরপর ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘যদি ভাবো’। অ্যালবামের ‘ডিজিটাল ফোয়া’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয় এবং রিয়াদকে এনে দেয় জাতীয় পরিচিতি। তাঁর গানের ভাষা সহজ, কিন্তু ভাব গভীর। জীবনের যাপিত মুহূর্ত, শহরের গন্ধ আর আঞ্চলিক সংস্কৃতি মিশে থাকে তার গানে। তিনি বলেন, “শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব আর শেফালি ঘোষের গান শুনে বড় হয়েছি। তাঁদের গানই আমাকে শেখায়, জীবনমুখী কথার মধ্যে কত গভীর সুর লুকিয়ে থাকে। ” এই প্রেরণা থেকে জন্ম নেয় ‘জিইসি মোড়’ শিরোনামের গানটি যা হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের শহুরে প্রেম ও বাস্তবতার প্রতীক। 

অনুপ্রেরণা ও যাত্রার মোড়

গানের চর্চা ও অনুপ্রেরণার প্রসঙ্গে রিয়াদ বলেন, “আমার গান লেখার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে চট্টগ্রামের দুজন লোকসংগীতশিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালি ঘোষ। তাঁদের গানে সব সময় যাপিত জীবন, মানুষের গল্প ও আঞ্চলিকতা ছিল। এমনভাবে তারা গান বানাতেন আর গাইতেন যে দর্শক-শ্রোতা হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করত। তাঁদের মতো করেই আমি বর্তমান সময়টাকে ধরে রাখতে চাই গানে। ” ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘সাতকানিয়া-ফটিকছড়ি’ শিরোনামের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সুরে লেখা গান। এটি স্থানীয় সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। আর ২০২৪ সালে কোক স্টুডিও বাংলার ‘মুড়ির টিন’ গাওয়ার পর রিয়াদ পৌঁছে যান নতুন উচ্চতায়। গানটি শুধু তাঁর কণ্ঠের জন্য নয়, কথার জন্যও প্রশংসিত হয়। কারণ এর গীতিকার ও সুরকার দুজনই রিয়াদ নিজে। নিজের গান ও কোক স্টুডিও বাংলার সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাই তরুণ এই সংগীতশিল্পীর কাছে। তিনি বলেন, “গান গাওয়া আর লেখার চেষ্টা করছি অনেক দিন ধরে। প্রমিত বাংলায় লিখলেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি আমার আলাদা টান আছে। সেই টান থেকেই নিজ এলাকার ভাষায় গান লেখা, সুর করা এবং গাওয়া। ‘মুড়ির টিন’ আমাদের যাপিত জীবনের গল্প, চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের কথার সুর। ”

রিয়াদ হাসান

শিশুদের জন্য সংগীতচর্চা

রিয়াদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নের রশিদাবাদ গ্রামে। স্ত্রী ও চার বছরের কন্যা রাইকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ছোট্ট সংসার। তবে তাঁর স্বপ্ন কেবল নিজের গানে সীমাবদ্ধ নয়—তিনি চান পরবর্তী প্রজন্মও সংগীতচর্চায় যুক্ত হোক। 

 ২০১৬ সালে বন্ধু শাইক সালেকিনকে সঙ্গে নিয়ে চালু করেন শিশুদের গিটার শেখার স্কুল ‘ডা ক্যাপো’। উত্তরায় এখনো এই স্কুলের কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি শিশুদের জন্য ছড়াগান তৈরির উদ্যোগ ‘কিচিরমিচির’ নিয়েও কাজ করছেন তিনি। ইউটিউবে এই নামেই পরিচালিত হচ্ছে একটি চ্যানেল। যেখানে শিশুদের উপযোগী গান তৈরি করছেন রিয়াদ ও তাঁর সহযোদ্ধারা। রিয়াদ বলেন, “গান ভালো লাগে বলেই করে যাচ্ছি। প্রতিদিনই শিখছি নতুন কিছু। সংগীত আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর যাত্রা। ”