মাদারীপুরের কালকিনিতে ছেলে ও নাতির মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না মতিন শিকদার। শুক্রবার বিকেলে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসেরহাট এলাকায়
মাদারীপুরের কালকিনিতে ছেলে ও নাতির মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না মতিন শিকদার। শুক্রবার বিকেলে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসেরহাট এলাকায়

ট্রিপল মার্ডার

‘ঘরে আইসা পোলা-নাতি এক রাতও কাটাইতে পারল না, ধাওয়াইয়া মাইরা ফালাইল’

প্রায় চার মাস পর নিজের বাড়িতে এসেছিলেন ইউপি সদস্য আক্তার শিকদার। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বড় ছেলেও। রাত কাটিয়ে সকালেই তাঁদের চলে যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সকাল হওয়ার আগেই প্রতিপক্ষের হামলায় প্রাণ হারান আক্তার শিকদার ও তাঁর ছেলে মারুফ শিকদার। মর্মান্তিক এই মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না আক্তারের বাবা মতিন শিকদার।

মতিন শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাগো ঘরদুয়ার পুইড়া ফালাইছে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ছেলে ও নাতি আসছিল দেখতে। ঘরে আইসা এক রাতও কাটাইতে পারল না। ওরা আমার পোলা–নাতিরে ধাওয়াইয়া মাইরা ফালাইল। ওগের বিচার চাই আমি। খুনিগো ফাঁসি দেইখা যেন মরতে পারি।’

শুক্রবার ভোরে মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের মধ্যেরচর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে হাতবোমার আঘাতে একজন ইউপি সদস্য, তাঁর ছেলে ও একজন দিনমজুর নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১০ জন।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন মধ্যেরচর এলাকার মতিন শিকদারের ছেলে আক্তার শিকদার (৪২), আক্তার শিকদারের ছেলে মারুফ শিকদার (২০) ও খুনেরচর গ্রামের সিরাজুল চৌকিদার (৩৫)। আক্তার শিকদার বাঁশগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ছিলেন। আর সিরাজুল ছিলেন পেশায় কৃষক ও দিনমজুর।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মধ্যেরচর এলাকায় ফকির ও শিকদার বংশের লোকজনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এলাকা ছাড়েন আওয়ামী লীগ নেতা আক্তার শিকদার। শুক্রবার ভোররাতে শরীয়তপুরের নতুন বাজার এলাকা দিয়ে আক্তার শিকদার তাঁর লোকজন নিয়ে মধ্যেরচর এলাকায় প্রবেশ করেন। এমন খবরে এলাকায় মাইকিং করে লোক জড়ো করে জলিল ফকিরের লোকজন। পরে আক্তার ও জলিলের লোকজন দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান। এ সময় বেশ কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করা হয়। হাতবোমার আঘাতে আক্তার শিকদার ঘটনাস্থলেই নিহত হন। বোমায় গুরতর আহত হন আক্তারের ছেলে মারুফ শিকদার (২০)। উদ্ধার করে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। বেলা ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান সিরাজুল চৌকিদার নামে আরেকজন। এ ছাড়া সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের বরিশালের মুলাদি ও শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে বাঁশগাড়ী ইউপির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ইউপি সদস্য আক্তারের বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা আছে। তার মধ্যে পাঁচটি হত্যা মামলা। সরকার পতনের পর এলাকা ছাড়ার পর নতুন করে দলবল নিয়ে এলাকায় প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। মধ্যেরচর এলাকার লোকজন তাঁদের প্রতিরোধ করতে গেলে সংঘর্ষ বাধে। বোমা বিস্ফোরণে আক্তার, তাঁর ছেলেসহ তিনজনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছেন। হামলার সঙ্গে যারা দায়ী তাঁদের বিচারের দাবি করেছেন তিনি।

কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হুমায়ুন কবির সন্ধ্যা ছয়টায় প্রথম আলোকে বলেন, তিনজনকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। এ ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন। নিহতের স্বজনদের থানায় এজাহার দিতে বলা হয়েছে। তাঁরা অভিযোগ দিলেই মামলা নথিভুক্ত করা হবে। পুলিশ হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছে। তাঁদের ধরতে কয়েক দফা অভিযানও চালানো হয়েছে।

এলাকাজুড়ে আতঙ্ক, সেনা-পুলিশ মোতায়েন

বাবা-ছেলেসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনায় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে আবার সংঘর্ষ এড়াতে বাঁশগাড়ী ইউনিয়নজুড়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাসদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় বিভিন্ন এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে।

সরেজমিনে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বাঁশগাড়ী ইউনিয়নের খাসেরহাট, পূর্বপাড়, মধ্যেরচরসহ পাঁচটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, চারপাশের পরিবেশ থমথমে। স্থানীয় সব দোকানপাট বন্ধ। হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে চাননি। গ্রামগুলোয় পুরুষ মানুষ নেই বললেই চলে। গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাসদস্যরা টহল দিচ্ছেন।

খাসেরহাট এলাকার মোবারক হোসেন (৫৫) বলেন, একসঙ্গে তিনজনকে খুনের ঘটনার পর সবাই আতঙ্কে আছেন। বাঁশগাড়ীতে মারামারি–খুন আগেও হয়েছে। চোখ তুলে নেওয়া, হাত–পা কেটে ফেলা এগুলো প্রতিনিয়ত ঘটে; কিন্তু এক দিনে তিনটি খুন হওয়ায় সবার মধ্যে আতঙ্ক। কখন যে কে হামলার শিকার হয় বলা যাচ্ছে না। বাড়িঘরেও ভাঙচুর এবং লুটপাট হতে পারে।

বাঁশগাড়ী এলাকার আবদুল কাদের বলেন, ‘এই ট্রিপল মার্ডার নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। অপরাধ না করেও ভয়ে অনেকেই এলাকা ছেড়েছে।’

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) ভাস্কর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রিপল মার্ডার ওই বাঁশগাড়ী এলাকায় প্রথম ঘটনা। এলাকায় ফের সংঘর্ষ এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ, সেনা ও র‍্যাবের টিম টহলে আছে। আপাতত পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে। নতুন করে কোনো সংঘাত আশা করছি হবে না। আসামিদের ধরতে অভিযান চলমান।’