
কেউ বন্ধুর জন্মদিনে কেক কাটছেন, ফেসবুকে ছবিও দিচ্ছেন, প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রাজশাহীতে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত রিকশাচালক গোলাম হোসেন (৪৮) হত্যা মামলার আসামিরা এভাবেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে বেড়ালেও তাঁদের খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। আসামিদের কেউ গ্রেপ্তারও হচ্ছেন না। এর ফলে এ হত্যা মামলার বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিহত রিকশাচালক গোলাম হোসেনের পরিবার।
৬ মার্চ নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতার ফ্ল্যাটে অভিযান ও তাঁর ভাইকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াকে কেন্দ্র করে পরদিন সন্ধ্যায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। দড়িখড়বোনা ও আশপাশের এলাকায় প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলা ওই সংঘর্ষে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে এবং গুলি ছোড়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তিনটি মোটরসাইকেল। ওই রাতে মহাজনের কাছে রিকশা জমা দিয়ে সংঘর্ষস্থল দিয়ে হেঁটে বাসায় যাচ্ছিলেন গোলাম হোসেন। তখনই বিএনপির একপক্ষ আরেক পক্ষের লোক ভেবে গোলাম হোসেনকে ছুরিকাঘাত করে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ মার্চ রাতে তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় ১৩ মার্চ ৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১৫-১৬ জনকে আসামি করে নগরের বোয়ালিয়া থানায় মামলা করেন গোলাম হোসেনের স্ত্রী পরিবানু বেগম। আসামির তালিকায় আছেন নগরের শাহ মখদুম থানা বিএনপির আহ্বায়ক সুমন সরদার, চন্দ্রিমা থানা বিএনপির আহ্বায়ক ফাইজুর হক, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মীর তারেক, মহানগর মহিলা দলের সহক্রীড়া সম্পাদক লাভলী খাতুনের স্বামী সোহেল রানা, লাভলীর ভাই মো. নাঈম এবং যুবদল কর্মী রনি।
নিহত গোলাম হোসেন থাকতেন নগরের দড়িখড়বোনা এলাকায় রেললাইনের পাশে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী পরিবানু জানান, স্বামী হত্যার পর এখন পর্যন্ত বিএনপির কোনো বড় নেতা তাঁর খোঁজ নেননি। তবে এলাকার কিছু নেতা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। মামলা না চালিয়ে চলার জন্য ‘কিছু একটা করে’ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার পরিবানু বলেন, ‘কেস তো করেছি, কিন্তু এখনো কোনো আসামি ধরা পড়েনি। আসলেই আসামিরা ধরা পড়বে কি না, তা জানি না। আমি একা কেস কতটুকু চালাতে পারব, সেটাও জানি না।’
এ মামলার আসামি সুমন সরদারের বিরুদ্ধে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জমি ও পুকুর দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ সামনে এসেছে। তাঁর ফেসবুক ঘেঁটে দেখা যায়, গতকাল সোমবারও তিনি নগরের রাজপাড়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক হাসান শিশিরের জন্মদিনে অংশ নিয়ে কেক কেটেছেন। সেই ছবিও পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। গত রোববার সুমন সরদার মামলার আরেক আসামি মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মীর তারেকের সঙ্গে একটি সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
মোমিনুল ইসলাম আতিফ নামের একজন সুমন সরদারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন মামলা হওয়ার পরের দিন। আতিফ লিখেছেন, ‘কমিটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাত ১টায় মিষ্টি খাওয়ার আয়োজন। হঠাৎ সুমন ভাইয়ের ফোন এবং আমাদের সঙ্গে যোগদান করে আরও আনন্দময় মুহূর্তটা বাড়িয়ে দেয়।’ এ ছাড়া সুমন সরদার দলীয় কয়েকটি কর্মসূচির লাইভ ভিডিও শেয়ার করেছেন নিজের ফেসবুকে।
মামলার আরেক আসামি নগরের চন্দ্রিমা থানা বিএনপির আহ্বায়ক ফাইজুর হকের ফেসবুকে গিয়ে দেখা গেছে, গতকাল তিনি চন্দ্রিমা থানা বিএনপি আয়োজিত ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়েছেন। সেই ছবি ট্যাগ করা হয়েছে ফাইজুল হকের ফেসবুক আইডিতে।
প্রভাবশালী মহিলা দল নেত্রী লাভলী খাতুনের স্বামী সোহেল রানা এবং লাভলীর ভাই মো. নাঈমেরও খোঁজ পায়নি পুলিশ। নাগাল পাওয়া যায়নি আরেক যুবদল কর্মী মো. রনিরও। তাঁরাও এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। তবে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
মামলার একজন আসামিও গ্রেপ্তার না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘মামলার পর বাদীর আর কিছু করার নেই। এখন আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশেরই দায়িত্ববোধ আছে। যদি আসামিরা এলাকাতেই থাকেন এবং গ্রেপ্তার না হন, তাহলে আমি থানা-পুলিশকে বলে দেব তৎপর হওয়ার জন্য। সাধারণ মানুষও এলাকায় তাঁদের দেখলে আমাদের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারেন। পুলিশকে সহায়তা করা নাগরিকদেরও দায়িত্ব।’