গাজীপুরে ঈদ বোনাসোর দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শ্রমিকেরা। গত শুক্রবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তেলিপাড়া এলাকায়
গাজীপুরে ঈদ বোনাসোর দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শ্রমিকেরা। গত শুক্রবার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের তেলিপাড়া এলাকায়

গাজীপুরে ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকদের ৮৩ বার মহাসড়ক অবরোধ

শিল্পনগরী গাজীপুরে বকেয়া পাওনাসহ নানা দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন থামছেই না। প্রায় প্রতিদিন জেলার কোথাও না কোথাও আন্দোলন লেগে আছে। গত ৫ আগস্টের পর গাজীপুরে অন্তত ৮৩ বার মহাসড়ক অবরোধ করেছেন শ্রমিকেরা। কয়েক দিন পরপর ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করায় অসহনীয় দুর্ভোগে পড়ছেন এসব পথে চলাচলকারী যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা।

সর্বশেষ আজ রোববার নগরের তেলিপাড়া এলাকায় ফেব্রুয়ারি মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন লুমেন টেক্সটাইল লিমিটেড কারখানার শ্রমিকেরা। এর আগে শুক্রবার একই এলাকার স্মাগ সোয়েটার লিমিটেড কারখানার শ্রমিকেরা ঈদ বোনাস বাড়ানোর দাবিতে টানা তিন ঘণ্টা মহাসড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন। ওই দিন শ্রমিক আন্দোলনের জেরে অনভিপ্রেত ঘটনা এড়াতে আশপাশের পাঁচ থেকে ছয়টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।

দাবি আদায়ে মহাসড়ক অবরোধের কারণ জানতে চাইলে কারখানার শ্রমিক আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমাগো দেশে যদি ভদ্রভাবে কোনো কথা কন, তাইলে কেউ হুনবো না। কথা হোনার মানুষও পাইবেন না। স্যারে গো বারবার কইতাছি, আমাগো সমস্যার সমাধান করেন। ঈদ বোনাস বাড়াইয়া দেন; কিন্তু তাঁরা কইতাছে দিব না। যার কারণে সড়ক বন্ধ কইরা আন্দোলন করতাছি। এহন সরকারের লোকজন আইবো, তখন ঠিকই আমাগো সমস্যার সমাধান হইয়া যাইব।’

কারখানা বন্ধের প্রতিবাদ ও বকেয়া বেতনের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকেরা। গত মঙ্গলবার সকালে গাজীপুরের টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকায়

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও এফবিসিসিআইয়ের সদস্য মো. সালাউদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকদের কোনো সমস্যা থাকলে তাঁরা বিজিএমইএতে যেতে পারেন, সেখানে সবার কথা বলার সুযোগ আছে। কিন্তু তা না করে যখন-তখন মহাসড়ক বন্ধ করে আন্দোলন করায় মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করতে নানা চক্রান্ত করা হচ্ছে। এ জন্য তাঁদের সজাগ থাকতে হবে। কথায় কথায় সড়ক বন্ধ করে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
শিল্প পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অবরোধ ছাড়াও অনেক জায়গায় বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকেরা। তবে বিক্ষোভ কারখানা এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। সাত মাসে জেলায় শতাধিক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে।

গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন করেছেন নগরের সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকেরা। গত ১৬ ডিসেম্বর পার্কের ১৬টি কারখানা একযোগে বন্ধ ঘোষণা (লে-অফ) করা হয়। এরপর ১৭ ডিসেম্বর থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকেরা। পাশাপাশি চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। টানা ছয় দিন অবরোধের পর বেতন পেয়ে তাঁরা মহাসড়ক ছাড়েন।

শিল্প পুলিশ ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকার গ্লোবাল অ্যাপারেলস লিমিটেড ও আগামী ওয়াশিং লিমিটেড কারখানার শ্রমিকেরা বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেছিলেন। অন্যদিকে বেতনের দাবিতে টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকার বিএইচআইএস অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিকেরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। জিরানী এলাকার রেডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ও আইরিশ ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল ও নাইট বিল বাড়ানোর দাবিতে টানা চার দিন চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবিদাওয়া মেনে নিলে এসব এলাকার পরিবেশ শান্ত হয়।

গাজীপুর মহানগরের জিরানি এলাকায় ডরিন ফ্যাশন কারখানার সামনে শ্রমিকদের বিক্ষোভ

অন্যদিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন কোনাবাড়ীর ইসলাম গার্মেন্টস লিমিটেড, রেজাউল অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফ্যাশন সুমিট লিমিটেড, কেএম নোভেলি লিমিটেড, স্বাধীন ফ্যাশন, ফ্যাশন পয়েন্ট, লাইফট্যাক্স লিমিটেড, কানিজ ফ্যাশন, এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড, পিএন কম্পোজিট, মুকুল নিটওয়্যার, কটন ক্লাব, এ্যামা সিনট্যাক্স, বেসিক ক্লথিং ও অ্যাপারেলস প্লাসের শ্রমিকেরা। চন্দ্রা এলাকায় মাহমুদ জিনস ও নূরুল স্পিনিং কারখানার শ্রমিকেরাও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এ ছাড়া পানিশাইল এলাকার ডরিন ফ্যাশন, চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনস, নূরুল ইসলাম স্পিনিংয়ের শ্রমিকেরা নানা দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন।

অবরোধের কারণে প্রায়ই দুর্ভোগে পড়েন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। গাজীপুরের ভিআইপি পরিবহনের চালক কবির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রমিকেরা যদি আন্দোলন করে সড়ক অবরোধ ও যানবাহন ভাঙচুর করে তবে এখন থেকে পরিবহনশ্রমিকেরাও আন্দোলন করবে। কারখানা শ্রমিকদের প্রতিহত করা হবে। তারাও শ্রমিক, আমরাও শ্রমিক। তাদের দাবি থাকলে কারখানায় আন্দোলন করবে, আমাদের রাস্তায় কেন আসবে?’

গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক অবরোধ করলে দ্রুত রেসপন্স পাওয়া যায়। সড়কে আটকা পড়াদের মধ্যে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, বিদেশগামী, মোটরশ্রমিকেরা থাকেন। তখন তাঁরা সবাই শ্রমিকদের পক্ষ নিলে জনমত তৈরি হয়। তখন পুলিশ, কলকারখানা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। তাঁরা চিন্তা করেন, এগুলো করলে দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, সাধারণ শ্রমিকেরা মনে করেন, বিজিএমইএ কিংবা কারখানা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঘুরে তাঁরা দ্রুত সমস্যার সমাধান পাবেন না। এ জন্য বকেয়া বেতন–ভাতার জন্য হুটহাট করে সড়ক অবরোধ করছেন। তাঁরা মনে করেন, সড়ক অবরোধ করলে প্রশাসন আসবে এবং দ্রুত তাঁদের সমস্যার সমাধান করে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সমাধানও পাচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে হলে প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকদের সংগঠন করতে দিতে হবে।