গুলিতে নিহত শ্রমিক জাকির হোসেনের কবরের পাশে তাঁর মা মিছিলি বেগম। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া গ্রামে
গুলিতে নিহত শ্রমিক জাকির হোসেনের কবরের পাশে তাঁর মা মিছিলি বেগম। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া গ্রামে

নতুন কেনা জমিতে ঘর তৈরির কথা ছিল, সেখানেই হলো ছেলের দাফন

জাকির হোসেনের বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন তাঁর বাবা ফজলু মিয়া মারা যান। দিনমজুর ফজলু মিয়ার নিজের ঘরবাড়ি, জায়গাজমি ছিল না। তাঁর স্ত্রী মিছিলি বেগম একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে ভাঙারির কাজ করে ছেলেকে বড় করেন। উপার্জনক্ষম ছেলের টাকায় সম্প্রতি গ্রামে ১৫ শতক জমিও কেনেন।মাসখানেকের মধ্যে ওই জমিতে নতুন ঘর তৈরির কথা ছিল, কিন্তু তা আর হলো না। একটি গুলিতে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। সেই জমিতেই ছেলের দাফন হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ছেলের কবরের পাশে মা মিছিলি বেগম আহাজারি করে এসব কথা বলছিলেন।

নিহত জাকির হোসেনের (২৪) বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া গ্রামে। তিনি ঢাকার বাড্ডা-নতুনবাজার এলাকায় মাকে নিয়ে একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে কাঁচপুর সেতুর কাছে একজন ঠিকাদারের অধীনে ওয়াসার পানির লাইন মেরামতের কাজ করতেন তিনি। ২১ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে কাঁচপুর সেতু এলাকায় গুলিতে মারা যান জাকির হোসেন।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে দুর্গাপুরের বাকলজোড়া গ্রামে গিয়ে মিছিলি বেগমকে ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে আলাপকালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ওর বাপ মরণের পরে ঘরবাড়ি না থাকায় জাকিররে লইয়া ঢাকার বাড্ডায় যাই। হেইহানে রাস্তায় ভাঙারি কুড়াইয়া মাইনষের বাসাত কাম কইরা ছেলেডারে বড় করছি। ১৫-১৬ বছর বয়স হইলে ছেলে নিজে কাম শুরু করে। এতে কইরা আমার কিছুডা দুঃখ দূর হয়। ছেলের আয়ের টেহা দিয়া গ্রামে ঘর উঠানোর লাইগা ১৫ শতক জায়গা কিনছি। কিন্তু আমার সব শেষ হইয়া গেল। আল্লাহ, আমারে তুমি এত কষ্ট ক্যারে দিলা? আমার বুকের একমাত্র ধনরে তুমি কেড়ে নিলা, অহন আমি কী নিয়া বাঁচবাম? আমারে আমার পুতের কাছে লইয়া যাও। আমি আর বাঁচতে চাই না।’

স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, কারফিউর মধ্যে ২১ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে কাঁচপুর সেতু এলাকায় একটি ভবনে কাজ করছিলেন জাকির হোসেন। বাইরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। ওই দিন কাজ শেষে বিকেলে পাশের একটি দোকানে চা-নাশতা খেতে যান জাকির। এ সময় হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে তাঁর পিঠে। গুলি লাগার পর দৌড়ে পাশের একটি গলিতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরে সেখানেই তিনি মারা যান। অন্য সহকর্মীরা লাশ নিয়ে যান জাকিরের মায়ের কাছে বাড্ডার নতুনবাজার এলাকায়। মা রাতেই লাশ নিয়ে রওনা হন গ্রামের বাড়ি দুর্গাপুরের বাকলজোড়া গ্রামে। ২২ জুলাই সকালে জানাজা শেষে নতুন কেনা জমিতে জাকিরের লাশ দাফন করা হয়।

নাশতা খাইতে গিয়া গুলিতেই আমার ছেলেডা মইরা গেল। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেডার দিকে চাইয়া জীবনটা পার কইরা দিছিলাম। বন্দুকের গুলি আমার সব আশা, স্বপ্ন ভাইঙা দিছে।
মিছিলি বেগম, গুলিতে নিহত জাকির হোসেনের মা

মিছিলি বেগম বলেন, ‘আন্দোলন শুরুর তিন-চার দিন আগে কাঁচপুর সেতুর কাছে কাম করতে গেছিল আমার মানিক। আন্দোলনের কারণে ভয়ে বাসায় না আইয়া সেইখানেই থাইক্যা যায়। ফোনে ছেলে কইছিল, “আম্মা, আন্দোলন চলছে, গুলি চলছে, বাসায় আসলে রাস্তায় গুলি লাগতে পারে।” কিন্তু নাশতা খাইতে গিয়া গুলিতেই আমার ছেলেডা মইরা গেল। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেডার দিকে চাইয়া জীবনটা পার কইরা দিছিলাম। বন্দুকের গুলি আমার সব আশা, স্বপ্ন ভাইঙা দিছে। আমার পৃথিবী শেষ হইয়া গেছে। আল্লাহ যেন এর বিচার করেন।’

নেত্রকোনা জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) লুৎফর রহমান বলেন, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় মারা যাওয়া নেত্রকোনায় ছয়টি লাশের দাফন হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জাকির নামের একজন আছেন।

নিহত জাকিরের খালাতো ভাই এন্টাস মিয়া বলেন, ‘আমার খালাতো ভাই জাকির কোনো ঝামেলাত জড়াত না। ঢাকায় শ্রমিকের কাজ করত। এইভাবে তার মৃত্যু হইব, আমরা কোনো দিন ভাবতে পারি নাই।’