উল আর সুতায় কম্বল বুনছেন একজন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কিসমত কেশুরবাড়ী গ্রামে
উল আর সুতায় কম্বল বুনছেন একজন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কিসমত কেশুরবাড়ী গ্রামে

ঠাকুরগাঁওয়ে হারিয়ে গেছে তাঁতের খট খট শব্দ

রাস্তাঘাটে মানুষজনের দেখা নেই। কাকের ডাকের সঙ্গে ভেসে আসছে খট খট শব্দ। শব্দটি হস্তচালিত তাঁতের। বাড়ির ভেতরে উঁকি দিতেই দেখা মেলে, সপিন দেবনাথ একমনে তাঁত যন্ত্রে শব্দ তুলে পশমি সুতায় (উল) বুনে চলেছেন রঙিন কম্বল। কাছে গিয়ে ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাইলে বললেন, ‘সুখেই তো আছি!’

‘সত্যি সুখে আছেন?’ প্রশ্ন করতেই চড়া গলায় সপিন দেবনাথ বললেন, ‘মিথ্যা বলেছি নাকি?’ বললেন, ‘আগে গ্রামে ঘুরে আইস। যাওয়ার আগতে মোরঠে দেখা করে যান।’

সপিন দেবনাথের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কিসমত কেশুরবাড়ী গ্রামে। ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মহাসড়কের মুন্সিরহাট থেকে ১৫ মিনিটের পথ।

ওই গ্রামের ভবেশ দেবনাথের বাড়ি একেবারেই সুনসান। তিনি বাড়িতে নেই। কয়েক বছর হলো তিনি আর তাঁতে বসেন না। খানিকটা দূর থেকে তাঁর স্ত্রী ফাগুনী রানী বলেন, ‘তাক অ্যালা পাবেননি।’ কোথায় গেছেন? জবাব আসে, ‘তাঁতে আর পোষায় না। তাই অ্যালা মাঠত কাজ করছে।’

অপরিচিত মানুষ দেখে এগিয়ে এলেন লক্ষ্মী দেবনাথ। তাঁর সঙ্গে আলাপে জানা গেল, গ্রামটি একসময় তাঁতযন্ত্রে বোনা উলের কম্বলের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। গ্রামের ৫০০ পরিবারের অধিকাংশই কম্বল বুননের কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁরা একসময় লুঙ্গি ও গামছা তৈরি করতেন। ১৯৯০ সালের দিকে সোয়েটারের উল দিয়ে কম্বল বুনতে শুরু করেন। এই তাঁতশিল্প সে সময় গ্রামের মানুষকে আর্থিক স্বচ্ছলতা দিয়েছিল। গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়ির বারান্দায় বসানো থাকত তাঁত আর চরকা। কেউ কেউ স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতেন। আর কেউ মহাজনদের কাছ থেকে উল নিয়ে চাহিদা মতো তৈরি করে দিতেন কম্বল। তাঁতি, পাইকার আর ফড়িয়াদের আসাগোনায় জমজমাট থাকত গ্রামটি।

এখন সেই দিন আর নেই। দিনে দিনে লাভের সঙ্গে সঙ্গে বাজারও কমেছে। আর এতেই ধীরে ধীরে তাঁতের সেই খট খট আওয়াজ কমতে থাকে। এখন গ্রামে তাঁতের শব্দ খুব একটা পাওয়া যায় না। এখন এখানে তাঁত চলে বড়জোর ১০ কি ১২টি।

কেন এমন হলো? শ্যামলের সঙ্গে যোগ দেন গোবিন্দ দেবনাথ। তিনি তাঁতের মালিক ছিলেন। এখন মাঝেমধ্যে তাঁত চালান তিনি। তাঁর ভাষ্য, উলের দাম বেশি। সেই তুলনায় ব্যবসা জমে না। উত্তম দেবনাথ যোগ করলেন, ‘শুধু কী উলের দাম? কেনার লোকও তো নাই!’ আলোচনায় যোগ দেন বরুন দেবনাথ। তাঁর কথা সোজাসাপটা, শীত এলে সরকার ব্লেজারের কম্বল দেয়। সরকার যদি তাঁদের এই কম্বলের দিকে একটু নজর দিত, তাহলে তাঁদের কাজটা টিকে থাকত।

তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা  যায়, তাঁতিদের পুঁজির সংকট আছে, তা ছাড়া বেড়েছে উলের দাম। এ কারণে তাঁতিরা এখন আর আগের মতো কম্বল বুনছেন না। অনেক তাঁতি পরিবার জীবন-জীবিকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। এসব কারণে হস্তচালিত তাঁত দিন দিন কমছে। তাঁতের কাজ না থাকায় অনেকে তাঁত সরিয়ে ফেলেছেন। সেগুলো এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।

ঘরের বারান্দায় বসে সুতা গোছাচ্ছিলেন তাঁতি বলাই চন্দ্রনাথ। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ফুলরানী চরকা ঘোরাচ্ছেন। বলাই চন্দ্র বলেন, তাঁরা শাওয়ালহাট গিয়ে কম্বলের সুতা কিনে আনেন। যে সুতা তাঁরা দুই তিন বছর আগে প্রতি মণ ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় কিনেছিলেন, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার টাকা। কম্বল বুননে এতে খরচ বেড়ে গেছে। তবে খরচ বাড়লেও কম্বলের দাম বাড়েনি। এ কারণে কম্বল ব্যবসায় আর আগের মতো পোষায় না। আবার তাঁতিরা এখন আর আগের মতো পুঁজিও বিনিয়োগ করতে পারছেন না। গ্রামের অনেকেই তাঁত বন্ধ করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

ছোট থেকেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে তাঁতে কম্বল বুনতেন পঞ্চ দেবনাথ। বছর তিনেক হলো তিনি এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন তিনি একটি পাটকলে কাজ করেন। পঞ্চ দেবনাথের মতো যগেন্দ্র দেবনাথ, রঘুনাথ দেবনাথও তাঁত বন্ধ করে দিনমজুরির কাজ করছেন। তাঁতি শ্যামল দেবনাথ ইজিবাইক চালান আর উত্তম দেবনাথ ব্যবসা করেন। তাঁতের কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে পঞ্চ দেবনাথ বললেন, কম্বলের দাম নাই। সুতা ও উলের দাম বেড়ে গেছে। উলের কম্বলের আগের মতো চাহিদাও নাই। যে পরিমাণ আয় হতো তাতে সংসার চলত না। উপায় না পেয়ে তিনি এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

রাস্তার পাশে দুলাল দেবনাথের বাড়ি। খট খট শব্দ শুনে বোঝা গেল, ভেতরে তাঁত চলছে। ভেতরে যেতেই দেখা গেল, দুলাল কম্বল বুনছেন। আর উঠানের এক পাশে তাঁর বৌদি বাহারি রঙের সুতা গোচ্ছাচ্ছেন। দুলাল বলেন, তাঁদের কম্বলের কাজ ভালোই চলছিল। কিন্তু বাজারে ব্লেজারের কম্বল আসার পর আর চলছে না। এখন ১০-১২টা তাঁত টিকে আছে। অনেকেই টিকতে না পেরে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ শ্রমিকের কাজ করছেন। কেউ কেউ টুকটাক ব্যবসা করছেন।

শীতের কম্বল বোনার আগে উল গোছাচ্ছেন একজন। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার কিসমত কেশুরবাড়ী গ্রামে

এলাকার প্রবীণ শিক্ষক কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, এই এলাকার তাঁতিদের আর আগের মতো জৌলুশ নেই। যাঁরা এ পেশায় টিকে আছেন, তাঁদের অন্য পেশায় যাওয়ার সামর্থ নেই। আর বেশি দেরি নাই, এলাকার একটি বাড়িতেও এ তাঁতযন্ত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে পৃষ্টপোষকতার দরকার।

ফেরার পথে দেখা সেই সপিন দেবনাথের সঙ্গে। বললেন, ‘তাঁত আর তাঁতিদের অনেক কথাই শুনলেন। এখন তো বুঝলেন, আমরা কেমন সুখে আছি!’  

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, শীতার্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য জেলায় এবার ৯০ হাজার কম্বল আর ৪০ লাখ টাকার চাহিদা পাঠানো হয়। বরাদ্দ এসেছে ২১ হাজার কম্বল ও সাড়ে ৩৩ লাখ টাকা।

স্থানীয় তাঁতে তৈরি কম্বল বিতরণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, তাঁতিদের জন্য এমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায় কি না, তা তিনি বিবেচনা করে দেখবেন।